- Sun Oct 11, 2020 7:18 pm#3710
শ্রীলংকার নয়া সরকার আবারও ভারত মহাসাগরকে শান্তির এলাকায় পরিণত করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। গত ১২ আগস্ট শ্রীলংকার নয়া সরকার শপথ গ্রহণ করেছে এবং মহিন্দা রাজাপাকসা আবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। ১৯৭১ সালে শ্রীলংকার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে ভারত মহাসাগরকে শান্তির এলাকা হিসেবে ঘোষণা করার জন্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে আহ্বান জানিয়েছিলেন। এর পাঁচ দশক পর প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসার নেতৃত্বাধীন সরকার আবার এ আহ্বান জানাল। তিনি এ আহ্বানটি জানালেন এমন এক সময় যখন চীন-ভারত সীমান্ত উত্তেজনা এখনও রয়েছে। লাদাখে যখন উত্তেজনা হ্রাস পায়নি, তখন ভারত দক্ষিণ চীন সাগরে তার নৌবাহিনীর জাহাজ পাঠিয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগরের কর্তৃত্ব নিয়ে চীনের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর দ্বন্দ্ব চলছে। এ অঞ্চলের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ রয়েছে। সেখানে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ নিয়মিত টহল দেয়। চীন সম্প্রতি ওই এলাকায় একটি নৌবাহিনীর মহড়া সম্পন্ন করেছে। ভারত মহাসাগর নিয়ে চীন-ভারত উত্তেজনা রয়েছে। চীনা স্বার্থকে চ্যালেঞ্জ করছে ভারত। দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ‘চীনা স্বার্থকে’ চ্যালেঞ্জ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র তার ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের স্ট্র্যাটেজিতে পরিবর্তন আনছে। এখানে ভারত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম পার্টনার।
একইসঙ্গে গত ৬ অক্টোবর জাপানের টোকিওতে QUAD বা Quadrilateral Security Dialogue-এর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়া QUAD-এর সদস্য। QUAD-এর উদ্যোগে এর আগে একটি নৌ-মহড়াও অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। ভারত-চীন সীমান্ত সমস্যার, বিশেষ করে লাদাখ অঞ্চলের সমস্যার যখন কোনো সমাধান হয়নি, ঠিক তখনই শ্রীলংকার পক্ষ থেকে ভারত মহাসাগরকে শান্তির অঞ্চল হিসেবে ঘোষণার দাবি জানানো হল।
সাম্প্রতিক সময়ে লাদাখে চীন ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনা বারবার আন্তর্জাতিক সংবাদের জন্ম দিচ্ছে। গত ১৫ জুনের পর থেকেই লাদাখ অঞ্চলে উত্তেজনা বজায় রয়েছে। লাদাখ ছিল এক সময় ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের অংশ। কিন্তু গেল বছর লাদাখকে কাশ্মীর থেকে আলাদা করে একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়। লাদাখে চীনের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে ভারতের। গত ১৫ জুন লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় চীন ও ভারতের মধ্যে সংঘর্ষ হয় এবং তাতে ২০ ভারতীয় সেনা মারা যান। সাম্প্রতিক সময়ে এটা ছিল একটা বড় ধরনের ঘটনা, যেখানে প্রচলিত যুদ্ধ না হয়েও এতজন ভারতীয় সেনাকে প্রাণ দিতে হয়। এরপর থেকেই গালওয়ান উপত্যকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। ভারতীয় সেনাপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ওই অঞ্চল সফর করেছেন। দু’পক্ষই সেখানে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করেছে। ভারত ফ্রান্স থেকে অত্যাধুনিক ৬টি রাফায়েল যুদ্ধ বিমান উড়িয়ে এনে তা ওই এলাকার কাছাকাছি হারিয়ানার আমবালা বিমান ঘাঁটিতে মোতায়েন করেছে। এই বিমানগুলোর অর্ডার অনেক আগেই দিয়েছিল ভারত। এ উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে ১০ সেপ্টেম্বর মস্কোতে ভারত ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ‘শান্তি ও স্থিতিশীলতা’ বজায় রাখার স্বার্থে একটি ঐকমত্যে উপনীত হয়েছিলেন। সেই ঐকমত্য ভেঙে গেছে। এক ধরনের শক্তি প্রদর্শনে লিপ্ত হয়েছে দেশ দুটি। গালওয়ান উপত্যকায় যখন উত্তেজনা বাড়ছে, তখনই দক্ষিণ চীন সাগরে ভারত যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছিল। দক্ষিণ চীন সাগরের কর্তৃত্ব নিয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এক ধরনের ‘স্নায়বিক যুদ্ধ’ চলছে। এমনই এক পরিস্থিতিতে সেখানে ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ পাঠানোর বিষয়টি চীন খুব সহজভাবে নেবে বলে মনে হয় না। শুধু তাই নয়, গালওয়ান উপত্যকায় উত্তেজনার পর ভারত আন্দামান-নিকোবরের কাছে মালাক্কা প্রণালিতেও নৌবহর পাঠিয়েছে। ভারতের উদ্দেশ্য একটাই- দক্ষিণ চীন ও মালাক্কা প্রণালিতে যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে চীনকে এক ধরনের ‘চাপে’ রাখা, যাতে চীন গালওয়ান উপত্যকা থেকে সরে যায় এবং সেখানে উত্তেজনা হ্রাস পায়।
এখানে আমরা গালওয়ানের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করতে পারি। গালওয়ান নদী আকসাই চীন ও লাদাখকে আলাদা করেছে। লাদাখের পূর্বে রয়েছে চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল তিব্বত, দক্ষিণে রয়েছে ভারতের হিমাচল রাজ্য, পশ্চিমে রয়েছে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গিলগিট-বাল্টিস্তান, আর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে রয়েছে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশ। সিয়াচিন হিমবাহ ও চীনের আকসাই চীন এ অঞ্চলের মাঝেই অবস্থিত। এ লাদাখেই অবস্থিত কারগিল, আর কারগিলে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের (১৯৯৯) কথা অনেকেই স্মরণ করতে পারেন। লাদাখের গুরুত্ব এ কারণে যে, তিব্বত চীনের অধিভুক্ত হওয়ার (১৯৫০-৫১) পর সাম্প্রতিককালে সেখানে চীনবিরোধী অসন্তোষ বাড়ছে। ১৯৫৯ সালে তিব্বতের ধর্মগুরু দালাই লামা ভারতে আশ্রয় নেন এবং এখনও সেখানে আছেন। ভারতের হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালায় একটি তিব্বতি নির্বাসিত সরকারের অস্তিত্বের খবরও আমরা জানি, যার প্রধান দালাই লামা স্বয়ং। ২০১৫ সালে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছিল, যেখানে তিব্বতি নেতাদের সঙ্গে চীনের কেন্দ্রীয় প্রশাসনের আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল। আর অতিসম্প্রতি, গত মে মাসে কংগ্রেসম্যান স্কট পেরি মার্কিন কংগ্রেসে একটি বিল (৬৯৪৮) উপস্থাপন করেছেন, যেখানে তিব্বতকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। তাই সঙ্গত কারণেই লাদাখের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব বাড়ছে।
তিব্বতের পাশাপাশি জিনজিয়াংয়ের অধিবাসী উইঘুর মুসলমানদের নিয়ে চীনের একটি ‘সমস্যা’ রয়েছে। উইঘুরে চীন মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, এ ধরনের অভিযোগ তুলে মার্কিন কংগ্রেসে একটি আইনও পাস হয়েছে (Uyghur Human Rights Policy Act of 2020, Uyghur Human Rights Policy Act of 2019, S. 3744)। উইঘুরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এবং এর পেছনে বাইরের শক্তির মদদের ব্যাপারে চীন অবগত। ফলে এ অঞ্চলে কোনো শক্তি চীনবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে যাতে জড়িত হতে না পারে, চীন সে ব্যাপারে সতর্ক।
সিয়াচিন হিমবাহ (১০০০ বর্গমাইল) নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষের খবর (১৯৮৪) আমরা জানি। চীনের কাছেও এ হিমবারের গুরুত্ব আছে। আকসাই চীনের একটি অংশ Shaksgam Valley একসময়ে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা পাকিস্তান চীনকে হস্তান্তর করে। আর ভারতের হিমাচল রাজ্যটি চীনের, এ দাবি থেকে চীন এখনও সরে আসেনি। গালওয়ান উপত্যকায় (১৪৭০০ বর্গমাইল) ভারতীয় কর্মকাণ্ডকে চীন তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ বলে মনে করছে। গালওয়ান উপত্যকার সীমানা চিহ্নিতকরণ সংক্রান্ত ‘লাইন অফ কন্ট্রোলের’ পাশাপাশি ভারত ২৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সড়ক নির্মাণ শেষ করেছে। এ সড়কটি লাদাখের রাজধানী লেহকে চীনা সীমান্তের কাছাকাছি দৌলতবেগ আলভি সামরিক বিমান ঘাঁটির সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। এটি একটি দুর্গম এলাকা। আগে লেহ থেকে দৌলতবেগ আলভি সামরিক বিমান ঘাঁটিতে পৌঁছতে দু’দিন লাগত। এখন লাগে মাত্র ৬ ঘণ্টা। ভারতীয় সমরনায়কদের কাছে দৌলতবেগ আলভি বিমান ঘাঁটির গুরুত্ব অনেক বেশি। এখান থেকে চীন নিয়ন্ত্রিত আকসাই চীন, যা ভারত নিজের বলে দাবি করে, তার সীমান্ত মাত্র ৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আর সিচিয়ান হিমবাহের দূরত্ব মাত্র ৮ কিলোমিটার। এ বিমান ঘাঁটিতে ভারত অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেছে। চীন কিংবা পাকিস্তানের সঙ্গে যে কোনো যুদ্ধে এ বিমান ঘাঁটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এই পুরো এলাকাটা মোটামুটি তিন ভাগে বিভক্ত। বর্তমানে যেখানে উত্তেজনা বিরাজ করছে, তা পশ্চিম অংশ হিসেবে বিবেচিত। লাদাখ ও আকসাই চীন এর অন্তর্ভুক্ত। মধ্যম অংশে অন্তর্ভুক্ত হিমাচল, উত্তরখণ্ড রাজ্য এবং তিব্বতের দক্ষিণ অংশের একটা অংশ আর পূর্ব অংশের অন্তর্ভুক্ত দক্ষিণ তিব্বত ও পূর্ব ভারত। পুরো এ তিনটি অংশেই অতীতে একাধিকবার সংঘর্ষ হয়েছে। ১৯৬২ সালে বহুল আলোচিত চীন-ভারত যুদ্ধ হয়েছিল লাদাখ ও আকসাই চীনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। ১৯৬৭ সালে সংঘর্ষ হয়েছিল সিকিমের নাথু লা ও চো লা গিরিপথের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। ১৯৭৫ সালেও এখানে দু’পক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময় হয়েছে। আর ২০১৭ সালে ডোকলামে একটি যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। ডোকলামে যুদ্ধ হয়নি বটে; কিন্তু দু’দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে আস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, তা আজও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। ফলে চীন-ভারত সীমান্ত সমস্যার যদি সমাধান না হয়, তাহলে ভারত মহাসাগরে শান্তির এলাকা ঘোষণা করার শ্রীলংকার প্রস্তাব আদৌ কোনো ফল দেবে না।
এদিকে ১২ অক্টোবর চীন ও ভারতের সেনা কমান্ডাররা সপ্তমবারের মতো বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন। তবে তাতে আদৌ কোনো ফল পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। কারণ লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় (এলওসি) চীনের ভূখণ্ডের দাবিকে ভারত সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে। সম্প্রতি চীনের সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেছেন, লাদাখ কোনোদিনই ভারতের অংশ ছিল না। লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করে ভারত চুক্তির শর্ত ভেঙেছে বলেও দাবি করা হয়। চীনের দাবি, তারা ১৯৫৯ সালের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা অনুসরণ করছে। ফলে সপ্তমবারের মতো সেনা কমান্ডারদের বৈঠক আদৌ কোনো ফল দেবে বলে মনে হয় না।
এদিকে চীনের সঙ্গে শ্রীলংকার যে বাণিজ্য চুক্তি হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে চীন-শ্রীলংকা বাণিজ্য চুক্তিতে চীন বেশি সুযোগ পেয়েছে। শ্রীলংকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এলাইনা বি টেপলিজ শ্রীলংকার ডেইলি মিররের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এ অভিমত পোষণ করেন। সম্প্রতি ভারতের সেনাপ্রধান ও পররাষ্ট্র সচিব মিয়ানমার সফর করেছেন। এর মধ্য দিয়ে চীনকে রুখতে মিয়ানমারকে কাছে টানছে ভারত- এমন একটি মূল্যায়নপত্র পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সেই সঙ্গে আছে আরও অনেক সংবাদ- ভারত চীনের সঙ্গে সীমান্তকে সামরিকায়ন করছে; ছটঅউ-এ যোগ দিতে শ্রীলংকার ওপর ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের চাপ; রাশিয়া থেকে ফাইটার জেট আনছে ভারত; ভারতের বিমানবাহিনী প্রধান ঘোষণা করেছেন, শিগগিরই ভারতের এয়ার ডিফেন্স কমান্ড ঘোষণা দেয়া হবে।
গত ৩ অক্টোবর নরেন্দ্র মোদি হিমাচল প্রদেশের রোহতাংয়ে ১০০০০ ফুট উচ্চতায় অতল টানেল বা সুড়ঙ্গপথের উদ্বোধন করেছেন। এ টানেল নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সামরিক। এই টানেল উদ্বোধনের ফলে সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় সেনা দ্রুত মোতায়েন করা যাবে। চীনকে টার্গেট করেই এ টানেল নির্মাণ। এর ফলে ভারতের অন্য অংশ থেকে লাদাখের লেহতে যাতায়াতের সময় কমে আসবে। সুতরাং এ এলাকার পরিস্থিতি যখন শান্তিপূর্ণ নয়, তখন ভারত মহাসাগরকে শান্তির অঞ্চলে পরিণত করার শ্রীলংকার আহ্বান কতটুকু কার্যকর হবে, তা একটা মৌলিক প্রশ্ন।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর
Collected:-
একইসঙ্গে গত ৬ অক্টোবর জাপানের টোকিওতে QUAD বা Quadrilateral Security Dialogue-এর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়া QUAD-এর সদস্য। QUAD-এর উদ্যোগে এর আগে একটি নৌ-মহড়াও অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। ভারত-চীন সীমান্ত সমস্যার, বিশেষ করে লাদাখ অঞ্চলের সমস্যার যখন কোনো সমাধান হয়নি, ঠিক তখনই শ্রীলংকার পক্ষ থেকে ভারত মহাসাগরকে শান্তির অঞ্চল হিসেবে ঘোষণার দাবি জানানো হল।
সাম্প্রতিক সময়ে লাদাখে চীন ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনা বারবার আন্তর্জাতিক সংবাদের জন্ম দিচ্ছে। গত ১৫ জুনের পর থেকেই লাদাখ অঞ্চলে উত্তেজনা বজায় রয়েছে। লাদাখ ছিল এক সময় ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের অংশ। কিন্তু গেল বছর লাদাখকে কাশ্মীর থেকে আলাদা করে একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়। লাদাখে চীনের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে ভারতের। গত ১৫ জুন লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় চীন ও ভারতের মধ্যে সংঘর্ষ হয় এবং তাতে ২০ ভারতীয় সেনা মারা যান। সাম্প্রতিক সময়ে এটা ছিল একটা বড় ধরনের ঘটনা, যেখানে প্রচলিত যুদ্ধ না হয়েও এতজন ভারতীয় সেনাকে প্রাণ দিতে হয়। এরপর থেকেই গালওয়ান উপত্যকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। ভারতীয় সেনাপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ওই অঞ্চল সফর করেছেন। দু’পক্ষই সেখানে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করেছে। ভারত ফ্রান্স থেকে অত্যাধুনিক ৬টি রাফায়েল যুদ্ধ বিমান উড়িয়ে এনে তা ওই এলাকার কাছাকাছি হারিয়ানার আমবালা বিমান ঘাঁটিতে মোতায়েন করেছে। এই বিমানগুলোর অর্ডার অনেক আগেই দিয়েছিল ভারত। এ উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে ১০ সেপ্টেম্বর মস্কোতে ভারত ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ‘শান্তি ও স্থিতিশীলতা’ বজায় রাখার স্বার্থে একটি ঐকমত্যে উপনীত হয়েছিলেন। সেই ঐকমত্য ভেঙে গেছে। এক ধরনের শক্তি প্রদর্শনে লিপ্ত হয়েছে দেশ দুটি। গালওয়ান উপত্যকায় যখন উত্তেজনা বাড়ছে, তখনই দক্ষিণ চীন সাগরে ভারত যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছিল। দক্ষিণ চীন সাগরের কর্তৃত্ব নিয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এক ধরনের ‘স্নায়বিক যুদ্ধ’ চলছে। এমনই এক পরিস্থিতিতে সেখানে ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ পাঠানোর বিষয়টি চীন খুব সহজভাবে নেবে বলে মনে হয় না। শুধু তাই নয়, গালওয়ান উপত্যকায় উত্তেজনার পর ভারত আন্দামান-নিকোবরের কাছে মালাক্কা প্রণালিতেও নৌবহর পাঠিয়েছে। ভারতের উদ্দেশ্য একটাই- দক্ষিণ চীন ও মালাক্কা প্রণালিতে যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে চীনকে এক ধরনের ‘চাপে’ রাখা, যাতে চীন গালওয়ান উপত্যকা থেকে সরে যায় এবং সেখানে উত্তেজনা হ্রাস পায়।
এখানে আমরা গালওয়ানের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করতে পারি। গালওয়ান নদী আকসাই চীন ও লাদাখকে আলাদা করেছে। লাদাখের পূর্বে রয়েছে চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল তিব্বত, দক্ষিণে রয়েছে ভারতের হিমাচল রাজ্য, পশ্চিমে রয়েছে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গিলগিট-বাল্টিস্তান, আর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে রয়েছে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশ। সিয়াচিন হিমবাহ ও চীনের আকসাই চীন এ অঞ্চলের মাঝেই অবস্থিত। এ লাদাখেই অবস্থিত কারগিল, আর কারগিলে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের (১৯৯৯) কথা অনেকেই স্মরণ করতে পারেন। লাদাখের গুরুত্ব এ কারণে যে, তিব্বত চীনের অধিভুক্ত হওয়ার (১৯৫০-৫১) পর সাম্প্রতিককালে সেখানে চীনবিরোধী অসন্তোষ বাড়ছে। ১৯৫৯ সালে তিব্বতের ধর্মগুরু দালাই লামা ভারতে আশ্রয় নেন এবং এখনও সেখানে আছেন। ভারতের হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালায় একটি তিব্বতি নির্বাসিত সরকারের অস্তিত্বের খবরও আমরা জানি, যার প্রধান দালাই লামা স্বয়ং। ২০১৫ সালে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছিল, যেখানে তিব্বতি নেতাদের সঙ্গে চীনের কেন্দ্রীয় প্রশাসনের আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল। আর অতিসম্প্রতি, গত মে মাসে কংগ্রেসম্যান স্কট পেরি মার্কিন কংগ্রেসে একটি বিল (৬৯৪৮) উপস্থাপন করেছেন, যেখানে তিব্বতকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। তাই সঙ্গত কারণেই লাদাখের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব বাড়ছে।
তিব্বতের পাশাপাশি জিনজিয়াংয়ের অধিবাসী উইঘুর মুসলমানদের নিয়ে চীনের একটি ‘সমস্যা’ রয়েছে। উইঘুরে চীন মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, এ ধরনের অভিযোগ তুলে মার্কিন কংগ্রেসে একটি আইনও পাস হয়েছে (Uyghur Human Rights Policy Act of 2020, Uyghur Human Rights Policy Act of 2019, S. 3744)। উইঘুরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এবং এর পেছনে বাইরের শক্তির মদদের ব্যাপারে চীন অবগত। ফলে এ অঞ্চলে কোনো শক্তি চীনবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে যাতে জড়িত হতে না পারে, চীন সে ব্যাপারে সতর্ক।
সিয়াচিন হিমবাহ (১০০০ বর্গমাইল) নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষের খবর (১৯৮৪) আমরা জানি। চীনের কাছেও এ হিমবারের গুরুত্ব আছে। আকসাই চীনের একটি অংশ Shaksgam Valley একসময়ে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা পাকিস্তান চীনকে হস্তান্তর করে। আর ভারতের হিমাচল রাজ্যটি চীনের, এ দাবি থেকে চীন এখনও সরে আসেনি। গালওয়ান উপত্যকায় (১৪৭০০ বর্গমাইল) ভারতীয় কর্মকাণ্ডকে চীন তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ বলে মনে করছে। গালওয়ান উপত্যকার সীমানা চিহ্নিতকরণ সংক্রান্ত ‘লাইন অফ কন্ট্রোলের’ পাশাপাশি ভারত ২৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সড়ক নির্মাণ শেষ করেছে। এ সড়কটি লাদাখের রাজধানী লেহকে চীনা সীমান্তের কাছাকাছি দৌলতবেগ আলভি সামরিক বিমান ঘাঁটির সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। এটি একটি দুর্গম এলাকা। আগে লেহ থেকে দৌলতবেগ আলভি সামরিক বিমান ঘাঁটিতে পৌঁছতে দু’দিন লাগত। এখন লাগে মাত্র ৬ ঘণ্টা। ভারতীয় সমরনায়কদের কাছে দৌলতবেগ আলভি বিমান ঘাঁটির গুরুত্ব অনেক বেশি। এখান থেকে চীন নিয়ন্ত্রিত আকসাই চীন, যা ভারত নিজের বলে দাবি করে, তার সীমান্ত মাত্র ৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আর সিচিয়ান হিমবাহের দূরত্ব মাত্র ৮ কিলোমিটার। এ বিমান ঘাঁটিতে ভারত অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেছে। চীন কিংবা পাকিস্তানের সঙ্গে যে কোনো যুদ্ধে এ বিমান ঘাঁটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এই পুরো এলাকাটা মোটামুটি তিন ভাগে বিভক্ত। বর্তমানে যেখানে উত্তেজনা বিরাজ করছে, তা পশ্চিম অংশ হিসেবে বিবেচিত। লাদাখ ও আকসাই চীন এর অন্তর্ভুক্ত। মধ্যম অংশে অন্তর্ভুক্ত হিমাচল, উত্তরখণ্ড রাজ্য এবং তিব্বতের দক্ষিণ অংশের একটা অংশ আর পূর্ব অংশের অন্তর্ভুক্ত দক্ষিণ তিব্বত ও পূর্ব ভারত। পুরো এ তিনটি অংশেই অতীতে একাধিকবার সংঘর্ষ হয়েছে। ১৯৬২ সালে বহুল আলোচিত চীন-ভারত যুদ্ধ হয়েছিল লাদাখ ও আকসাই চীনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। ১৯৬৭ সালে সংঘর্ষ হয়েছিল সিকিমের নাথু লা ও চো লা গিরিপথের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। ১৯৭৫ সালেও এখানে দু’পক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময় হয়েছে। আর ২০১৭ সালে ডোকলামে একটি যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। ডোকলামে যুদ্ধ হয়নি বটে; কিন্তু দু’দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে আস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, তা আজও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। ফলে চীন-ভারত সীমান্ত সমস্যার যদি সমাধান না হয়, তাহলে ভারত মহাসাগরে শান্তির এলাকা ঘোষণা করার শ্রীলংকার প্রস্তাব আদৌ কোনো ফল দেবে না।
এদিকে ১২ অক্টোবর চীন ও ভারতের সেনা কমান্ডাররা সপ্তমবারের মতো বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন। তবে তাতে আদৌ কোনো ফল পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। কারণ লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় (এলওসি) চীনের ভূখণ্ডের দাবিকে ভারত সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে। সম্প্রতি চীনের সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেছেন, লাদাখ কোনোদিনই ভারতের অংশ ছিল না। লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করে ভারত চুক্তির শর্ত ভেঙেছে বলেও দাবি করা হয়। চীনের দাবি, তারা ১৯৫৯ সালের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা অনুসরণ করছে। ফলে সপ্তমবারের মতো সেনা কমান্ডারদের বৈঠক আদৌ কোনো ফল দেবে বলে মনে হয় না।
এদিকে চীনের সঙ্গে শ্রীলংকার যে বাণিজ্য চুক্তি হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে চীন-শ্রীলংকা বাণিজ্য চুক্তিতে চীন বেশি সুযোগ পেয়েছে। শ্রীলংকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এলাইনা বি টেপলিজ শ্রীলংকার ডেইলি মিররের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এ অভিমত পোষণ করেন। সম্প্রতি ভারতের সেনাপ্রধান ও পররাষ্ট্র সচিব মিয়ানমার সফর করেছেন। এর মধ্য দিয়ে চীনকে রুখতে মিয়ানমারকে কাছে টানছে ভারত- এমন একটি মূল্যায়নপত্র পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সেই সঙ্গে আছে আরও অনেক সংবাদ- ভারত চীনের সঙ্গে সীমান্তকে সামরিকায়ন করছে; ছটঅউ-এ যোগ দিতে শ্রীলংকার ওপর ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের চাপ; রাশিয়া থেকে ফাইটার জেট আনছে ভারত; ভারতের বিমানবাহিনী প্রধান ঘোষণা করেছেন, শিগগিরই ভারতের এয়ার ডিফেন্স কমান্ড ঘোষণা দেয়া হবে।
গত ৩ অক্টোবর নরেন্দ্র মোদি হিমাচল প্রদেশের রোহতাংয়ে ১০০০০ ফুট উচ্চতায় অতল টানেল বা সুড়ঙ্গপথের উদ্বোধন করেছেন। এ টানেল নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সামরিক। এই টানেল উদ্বোধনের ফলে সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় সেনা দ্রুত মোতায়েন করা যাবে। চীনকে টার্গেট করেই এ টানেল নির্মাণ। এর ফলে ভারতের অন্য অংশ থেকে লাদাখের লেহতে যাতায়াতের সময় কমে আসবে। সুতরাং এ এলাকার পরিস্থিতি যখন শান্তিপূর্ণ নয়, তখন ভারত মহাসাগরকে শান্তির অঞ্চলে পরিণত করার শ্রীলংকার আহ্বান কতটুকু কার্যকর হবে, তা একটা মৌলিক প্রশ্ন।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর
Collected:-