- Tue Jun 23, 2020 9:14 pm#2814
নবাব সিরাজউদ্দৌলার পুরো নাম মির্জা মোহাম্মদ সিরাজউদ্দৌলা। নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাংলা, বিহার ও উরিষ্যার নবাব ছিলেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাংলা, বিহার ও উরিষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব ছিলেন। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে বাংলা, বিহার ও উরিষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় হয়। নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ও মৃত্যুর পরই ভারতবর্ষে প্রায় দুশো বছরের ইংরেজ শাসন ও শোষণের সূচনা হয়।
সিরাজউদ্দৌলা তার নানা নবাব আলীবর্দী খান এর কাছ থেকে ২৩ বছর বয়সে ১৭৫৬ সালে বাংলার নবাবের ক্ষমতা লাভ করেন। তার সেনাপতি মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কারনে ২৩ জুন ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হন তিনি। রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার শাসন ভার গ্রহণ করে।
সিরাজউদ্দৌলার ব্যক্তিগত জীবন ও ক্ষমতাবসানের কিছু তথ্য:
• নবাব সিরাজউদ্দৌলা জন্মগ্রহণ করেন ১৭৩৩ সালে।
• নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন বাংলার নবাব আলীবর্দী খান এর নাতি।
• নবাব আলীবর্দী খান এর কোন পুত্র সন্তান ছিল না। আলীবর্দী খানের তিন কন্যা ছিলেন। তিন কন্যাকেই তিনি নিজের বড় ভাই হাজী আহম্মদ এর পুত্র নোজেস মোহাম্মদের সাথে বড় মেয়ে ঘষেটি বেগমের বিয়ে দেন, সৈয়দ আহম্মদের সাথে মেজ মেয়ে এবং জয়নু্দ্দীন আহম্মদের সাথে ছোট মেয়ে আমেনা বেগমের বিয়ে দেন। আমেনা বেগমের দুই পুত্র ও এক কন্যা ছিলেন । পুত্ররা হলেন মির্জা মোহাম্মদ তথা সিরাজউদ্দৌলা এবং মির্জা মেহেদী। আলীবর্দী খান যখন পার্টনার শাসনভার গ্রহণ করেন তখন ছোট কন্যা আমেনা বেগমের গর্ভে নবাব সিরাজউদ্দৌলার জন্ম হয় এই জন্য তিনি সিরাজের জন্মকে সৌভাগ্যের লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করে নবজাত শিশু সন্তান সিরাজউদ্দৌলাকে আনন্দের আতিশয্যে পোষ্য পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। সিরাজ তার নানা কাছে ছিলেন খুবই আদরের। যেহেতু আলীবর্দী খানের কোন পুত্র ছিলনা সেহেতু সিরাজ তার নানার কাছে অনেক স্নেহ আদরে বড় হতে থাকল। সিরাজউদ্দৌলার জন্ম সাল নিয়ে মতভেদ রয়েছে, তবে অধিক গ্রহণযোগ্য মত হল সিরাজউদ্দৌলা ১৭৩২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৭৪৬ সালে আলীবর্দী খান মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গেলে কিশোর সিরাজ তার নানার যুদ্ধের সঙ্গী হন। আলীবর্দী খান সিরাজকে বালক বয়সেই পার্টনার শাসণকর্তা হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। তখন সিরাজের বয়স খুবই অল্প থাকার কারনে রাজা জানকি রামকে রাজপ্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু বিষয়টি সিরাজউদ্দৌলাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি তাই তিনি একদিন গোপনে কয়েকজন বিষস্ত অনুচরকে সঙ্গেনিয়ে ভ্রমণের নাম করে স্ত্রী লুৎফন্নেসাকে সঙ্গে নিয়ে মুর্শীদাবাদ থেকে বের হয়ে পড়েন। বিনা অনুমতিতে জানকি রাম তার ক্ষমতা ছেড়ে দিতে অস্বীকার করেন। দুর্গের দ্বার বন্ধ করে বৃদ্ধ নবাবের কাছে বিস্তারিত তথ্য জানিয়ে দূত পাঠান জানকি রাম। অন্য দিকে জানকি রামের আচরনে ক্ষুব্দ হয়ে সিরাজউদ্দৌলা দূর্গে আক্রমন করেন। উভয় পক্ষে লড়াই শুরু হয়েগেলে হতাহতের ঘটনাও ঘটে। ঘটনার সংবাদ পেয়ে আলীবর্দী খান দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেন। সেদিন দুর্গের অভন্তরের দরবারে বসে আলীবর্দী খান তার স্নেহভাজন দৌহিদ্র সিরাজকে পাশে বসিয়ে দরবারে ঘোষণা দেন যে, আমার পরবর্তীতে বাংলা, বিহার ও উরিষ্যার মসনদে বসবে সিরাজ। ইতিহাসের এই ঘটনাকে সিরাজউদ্দৌলার যৌব রাজ্যাভিশেক বলে অভিহিত করা হয়। এই সময় সিরাজউদ্দৌলার বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর। তবে তার সিংহাসনের উত্তরাধিকার হিসেবে মনোনয়নের এই ঘটনা তার আত্মীবর্গরা মেনেনিতে পারেনি। অনেকেই তার বিরোধীতা শুরু করেন। এদের মধ্যে ছিলেন আলীবর্দী খান এর বড় মেয়ে ঘষেটি বেগম এবং তার স্বামী নোয়াজেস মোহাম্মদ।
• এছাড়াও আলীবর্দী খানের জীবদ্দশায় সিরাজউদ্দৌলা ঢাকার নৌবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
• অবশেষে ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল তার নানা আলীবর্দী খান মৃত্যুবরন করেন। সেই সময় এক দূর্যোগময় অবস্থায় নবাব সিরাজউদ্দৌলা নবাব হিসেবে সিংহাসনে আরহন করেন।
• সিরাজউদ্দৌলা যখন সিংহাসনে আরহন করেন তখন থেকেই কোলকাতায় ইংরেজদের প্রাদুর্ভাব ধীরে ধীরে বারতে থাকে। তিনি ইংরেজদের দমন করার জন্য কাসেম বাজারের পুঠিয়াল ও ওয়াসনকে কোলকাতার দূর্গ প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলতে ও ভবিষ্যতে নবাবের পূর্বানুমতি ছাড়া এ ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে তার নির্দেশ দেন কিন্তু ইংরেজরা তার এই আদেশ অমান্য করে তাদের কাজ বহাল রাখে। নবাব তখন বুঝতে পারলেন ইংরেজরা তার গৃহ বিবাদের সুযোগ নিয়ে এ ধরনের কাজ করছে। সূতরাং প্রথমে তিনি ঘষেটি বেগমের চক্রান্তকে চূর্ণ করার জন্য সচেষ্ট হন। তিনি মতিঝিল প্রাসাদ অধিকার করে ঘষেটি বেগমকে মুর্শীদাবাদে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন। মতিঝিল অধিকার করে নবাব কাসিম বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হন। ২৭ মে তার সেনাবাহিনী কাসিম বাজারের দূর্গ অবরুদ করেন। তিনি কাসিম বাজারের কুঠিয়াল ও ওর্য়াশনকে তার দরবারে হাজির হয়ে তার নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করার জন্য অঙ্গীকার পত্র লেখতে বলেন। ওর্য়াশন এই অঙ্গিকার পত্র লেখতে বাধ্য হন। একই বছর ১৮ জুন সিরাজউদ্দৌলা কোলকাতা আক্রমন করেন। তুমুল যুদ্ধ হওয়ার পর ২০ জুন কলকাতা দূর্গ সিরাজের দখলে আসে। তিনি দরবারে প্রবেশ করেন এবং দরবারে উপবেশন করে উমিচাদ ও কৃষ্ণবল্লবকে দরবারে উপস্থিত হওয়ার আদেশ দেন। এর পর সেনাপতি মানিকচাদের হাতে দূর্গের শাসণভার ছেড়ে দিয়ে সিরাজউদ্দৌলা রাজধানীতে ফিরে আসেন। ১২ জুলাই তিনি রাজধানীতে প্রতার্বন করেন। এরপর দিল্লীর বাদশা পূর্ণিয়ার নবাব সওকত জংকে বাংলা, বিহার ও উরিষ্যার নবাবী সনদ পাঠান। সওকত জং নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা আয়োজন করেন। ইংজেরা এই সংবাদ পেয়ে গোপনে সওকত জং এর সাথে মিত্রতা করার চেষ্টা করতে থাকে। অপর দিকে মাদ্রাজের ইংজের দরবার কর্ণেল রবার্ট ক্লাইভকে প্রধান সেনাপতি করে কলকাতা পুনরুদ্ধারের জন্য পাঠিয়ে দেন। সিরাজউদ্দৌলা শওকত জংকে প্রতিরোধ করার জন্য রওয়ানা হন। পথিমধ্যে নবাবগঞ্জ নামক স্থানে উভয় পক্ষ মুখোমুখি যুদ্ধে লিপ্ত হন। যুদ্ধে শওকত নিহত হন। সিরাজউদ্দৌলা মোহন লালের হাতে পূর্ণিয়ার শাসনভার অর্পন করে রাজধানীতে ফিরে আসেন। ক্লাইভ ও ওয়াটসন পোলতায় পৌছেই কলকাতা অভিমুখে রওনা হয়। প্রায় বিনাযুদ্ধে তারা কলকাতা জয় করে নেন। এর আগে ক্লাইভ ও ওয়াটসন কলকাতায়ে এসে সিরাজউদ্দৌলার কাছে সন্ধির প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন এবং সিরাজউদ্দৌলা তাতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু ইংরেজরা শর্ত ভঙ্গ করে কলকাতা আক্রমন করে। সিরাজউদ্দৌলা তার মন্ত্রীদের কুচক্রের বিষয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। তাই ইংরেজদের প্রায় সকল প্রকার দাবিতে স্বীকার হয়ে ১৭৫৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারী একটি সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করেন। ইতিহাসে এই সন্ধি আলিনগরের সন্ধি নামে পরিচিত। কিন্তু ইংরেজরা তাদের মতিগতির কোন পরিবর্তন করল না। মূলত তাদের প্রতিদ্বদিতা ছিল ফরাসিদের সাথে। কিন্তু সিরাজউদ্দৌলা ফরাসিদের বেশি প্রাধান্য দিচ্ছিলেন। আলিনগরের সন্ধি পালনের জন্য নবাবকে যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল। সব ধরনের গোলমাল মোটামুটি শান্ত হওয়ার পর। নবাব সেনাপতিদের অপকর্মের বিচার শুরু করেন। মানিকচন্দ্রকে কারাবন্দি করা হয়। এটা দেখে রাজবল্লব, জগৎশেঠ ও মীরজাফর সবাই ভীত হয়ে পড়েন। স্বার্থ রক্ষার জন্য জগৎশেঠের মন্ত্রনাভবনে মিলিত হয়ে তারা ইংরেজদের সাথে হাত মিলিয়ে নবাবকে সিংহাসন চ্যুত্ত করে মীরজাফরকে সিংহাসনে বসানোর চক্রান্ত করে। ইয়ার লতিফ গোপনে ওয়াটসনের সাথে মিলিত হয়ে কুমন্ত্রণা দিলেন যে, সিরাজউদ্দৌলা খুব সহজেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন। আর এ কারনেই তিনি পলাশীতে শিবির স্থাপন করেছেন। ক্লাইভ এর পর তার সেনাবাহিনীর অর্ধেক লুকিয়ে রেখে বাকিদের নিয়ে কলকাতায় পৌছালেন। আর নবাবকে পত্র লিখলেন আমরা সেনাদল উঠিয়ে আনলাম আর আপনি পলাশিতে ছাউনি গেড়ে বসে রইলেন। নবাব সরল বিশ্বাসেই মীরজাফরকে ছাউনি তুলে মুর্শিদাবাদে যাওয়ার আদেশ দিলেন। মীরজাফর রাজধানীতে পৌছা মাত্রই ক্রাফটন তার সাথে মিলিতি হয়ে গোপনে সন্ধির খসড়া লিখে নিলেন। ১৭ মে কলকাতার ইংরেজদের দরবারে এই গোপন সন্ধিপত্রে খসড়া নিয়ে আলোচনা হয়। মীরজাফরের স্বাক্ষরের জন্য ১০ জুন তার কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু এই গুপ্ত বৈঠক আর গোপন থাকলনা। ক্লাইভ যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া শুরু করলেন। এদিকে গোপনে সন্ধি পত্রের সংবাদ জানতে পেয়ে সিরাজউদ্দৌলা মীরজাফরকে বন্দী করার ব্যবস্থা নিলেন। অন্যদিকে ওয়াটসন রাজধানী থেকে পালিয়ে গেল। অবশেষে বেজে উঠল পলাশী যুদ্ধের দাবানল। ১৭৫৭ সালের ১২ই জুন কলকাতায় ইংরেজ সেনারা চন্দন নগরের সেনাবাহিনীর সাথে মিলিত হয়। সেখানে দুর্গ রক্ষার জন্য অল্প কিছু সৈন্য রেখে তারা ১৩জুন অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ যাত্রা শুরু করে। কলকাতা থেকে মুর্শীদাবাদের পথে হুগলি, কাটোয়ার দূর্গ, অগ্রদ্বীপ নবাবের সৈন্য থাকা সত্ত্বেও তারা কেউ ইংরেজদের পথরোধ করলনা। নবাব বুজতে পারলেন সেনাপতিরাও এই ষড়যন্ত্রে সামিল। বিদ্রোহের আভাস পেয়ে নবাব মীরজাফরকে বন্দী করার চিন্তা বাদ দিলেন এবং মীরজাফরকে ক্ষমা করে তাকে শপথ নিতে বললেন। মীরজাফর পবিত্র কোরআন ছুয়ে শপথ করে অঙ্গিকার করলেন যে তিনি শরীরে এক বিন্দু রক্ত থাকতেও বাংলার স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন হতে দিবেন না। গৃহ বিবাদের মিমাংশা করে তিনি রায় দুর্লভ, ইয়ার লতিফ, মীরজাফর, মীর মদন, মোহন লাল ও ফরাসি সেনাপতি সিনফ্রে কে সৈন্য চালানোর দ্বায়িত্ব দিয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ যাত্রা শুরু করলেন। ২৩ জুন সকাল থেকেই পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজরা মুখোমুখি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হল। ইংরেজরা লক্ষবাদ নামক আমবাগানে সৈন্য সমাবেশ করল। বেলা ৮টার সময় হঠাৎ করেই মীর মদন ইংরেজ বাহিনীকে আক্রমন করেন। তার প্রবল আক্রমনে টিকতে না পেরে ক্লাইভ তার সেনাবাহিনী নিয়ে আমবাগানে আশ্রয় নেয়। ক্লাইভ কিছুটা বিচলিত হয়ে পরেন। মীর মদন ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিলেন। কিন্তু মীরজাফর, ইয়ার লতিফ ও রায় দুর্লভ যেখানে সৈন্য সমাবেশ করেছিলেন সেখানেই দাড়িয়ে রইলেন। তাদের সামান্য সহায়তা পেলেও হয়তো মীর মদন ইংরেজদের পরাজয় বরণ করতে বাধ্য করতে পারতেন। দুপুরের দিকে হঠাৎ বৃষ্টি নামলে নবাবের গোলাবারুদ ভিজে যায়। তবুও সাহসী মীরমদন ইংরেজদের সাথে লড়াই চালাতে থাকেন। কিন্ত হঠাৎ করেই গোলার আঘাতে মীরমদন মৃত্যুবরণ করেন। মীর মদনের মৃত্যুর পরেও অন্যতম সেনাপতি মোহন লাল যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। তিনি যুদ্ধ বিরুধীদের বিরুদ্ধে গিয়ে ইংরেজ বাহিনীকে আক্রমনের পক্ষে পক্ষপাতি ছিলেন। কিন্তু মীরজাফর আবারও বিশ্বাস ঘাতকতা করে তার সৈন্য বাহিনীকে শিবিরে ফিরে যাবার নির্দেশ দেন। এই সুযোগ নিয়ে ইংরেজরা নবাবকে আক্রমন করে। যুদ্ধ বিকাল ৫ টায় শেষ হয় এবং নবাবের ছাউনি ইংরেজদের দখলে আসে। ইংরেজদের পক্ষে ৭ জন ইউরোপিয়ান এবং ১৬ জন দেশিও সৈন্য নিহত হয়। তখন কোন উপায় না দেখে নবাব রাজধানী রক্ষার জন্য দুই হাজার সৈন্য নিয়ে মুর্শীদাবাদের উদ্দেশ্যে রেওনা হন। কিন্তু রাজধানী রক্ষার জন্য কেউ তাকে সাহায্য করেনি। নবাব তার স্ত্রী ও ভৃত্য গোলাম হোসেনকে নিয়ে রাজধানী থেকে বের হয়ে স্থল পথে ভগবানগোলায় পৌছে যায়। এবং সেখান থেকে নৌকা যোগে পদ্মা ও মহান্দার মধ্য দিয়ে উত্তর অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। তার আশা ছিল পশ্চিমাঞ্চলে পৌছাতে পারলেই ফরাসি সৈনিক মসিয়েনাস এর সহায়তায় পার্টনা পর্যন্ত গিয়ে রামনারায়নের কাছ থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে ফরাসি বাহিনীর সহয়তায় বাংলাকে রক্ষা করবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নবাবের এই আশা বাস্তবে রূপ লাভ করতে পারেনি। মীর জাফর রাজধানীতে পৌছে। নবাবকে খুজে না পেয়ে চারিদিকে লোক পাঠালেন। ১৭৫৭ সালের ৩ জুলাই নবাব মহন্দা নদীর স্রোত অতিক্রম করে এলেও জোয়ারভাটার ফলে জল কমে যাওয়ায় নদীর মোহনায় এসে তার নৌকা আটকে যায়। তিনি নৌকা থেকে নেমে খাবার সংগ্রহের জন্য একটি মসজিদের নিকটবর্তী বাজারে চলে আসেন। সেখানে কিছু লোক তাকে চিনে ফেলে অর্থে লোভে মীরকাশিমের সৈন্য বাহিনীকে খবর দেন। এ সম্পর্কে ভিন্ন আর একটি মত আছে যে, এক ফকির নবাবকে দেখে চিনে ফেলে। ইতোপূর্বে ঐ ফকির নবাব কর্তৃক শাস্তি পেয়ে তার একটি কান হারিয়ে ফেলেছিল। এই ফকিরই সৈন্য বাহিনীকে খবর দেয় এবং সৈন্যরা এসে নবাবকে বন্দি করে মুর্শীদাবাদে পাঠিয়ে দেয়। বন্দী হবার সময় নবাবের সাথে ছিলেন তার স্ত্রী লুৎফুন্নেসা বেগম এবং চার বছর বয়সী শিশু কন্যা উম্মে জহুরা। এর পরের দিন ৪ জুলাই মতান্তরে ৩ জুলাই মীরজাফরের আদেশে তার পুত্রের তত্ত্বাবধানে মহাম্মদীবেগ নামের এক ঘাতক নবাবকে হত্যা করে। কথিত আছে নবাবের মৃত্যুর পর তার মৃত দেহ হাতির পিঠে চড়িয়ে সারা শহর ঘোড়ানো হয়। মুর্শীদাবাদের খোশবাগে নবাব আলীবর্দী খানের কবরের পাশে বাংলা, বিহাড় উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
সিরাজউদ্দৌলা তার নানা নবাব আলীবর্দী খান এর কাছ থেকে ২৩ বছর বয়সে ১৭৫৬ সালে বাংলার নবাবের ক্ষমতা লাভ করেন। তার সেনাপতি মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কারনে ২৩ জুন ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হন তিনি। রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার শাসন ভার গ্রহণ করে।
সিরাজউদ্দৌলার ব্যক্তিগত জীবন ও ক্ষমতাবসানের কিছু তথ্য:
• নবাব সিরাজউদ্দৌলা জন্মগ্রহণ করেন ১৭৩৩ সালে।
• নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন বাংলার নবাব আলীবর্দী খান এর নাতি।
• নবাব আলীবর্দী খান এর কোন পুত্র সন্তান ছিল না। আলীবর্দী খানের তিন কন্যা ছিলেন। তিন কন্যাকেই তিনি নিজের বড় ভাই হাজী আহম্মদ এর পুত্র নোজেস মোহাম্মদের সাথে বড় মেয়ে ঘষেটি বেগমের বিয়ে দেন, সৈয়দ আহম্মদের সাথে মেজ মেয়ে এবং জয়নু্দ্দীন আহম্মদের সাথে ছোট মেয়ে আমেনা বেগমের বিয়ে দেন। আমেনা বেগমের দুই পুত্র ও এক কন্যা ছিলেন । পুত্ররা হলেন মির্জা মোহাম্মদ তথা সিরাজউদ্দৌলা এবং মির্জা মেহেদী। আলীবর্দী খান যখন পার্টনার শাসনভার গ্রহণ করেন তখন ছোট কন্যা আমেনা বেগমের গর্ভে নবাব সিরাজউদ্দৌলার জন্ম হয় এই জন্য তিনি সিরাজের জন্মকে সৌভাগ্যের লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করে নবজাত শিশু সন্তান সিরাজউদ্দৌলাকে আনন্দের আতিশয্যে পোষ্য পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। সিরাজ তার নানা কাছে ছিলেন খুবই আদরের। যেহেতু আলীবর্দী খানের কোন পুত্র ছিলনা সেহেতু সিরাজ তার নানার কাছে অনেক স্নেহ আদরে বড় হতে থাকল। সিরাজউদ্দৌলার জন্ম সাল নিয়ে মতভেদ রয়েছে, তবে অধিক গ্রহণযোগ্য মত হল সিরাজউদ্দৌলা ১৭৩২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৭৪৬ সালে আলীবর্দী খান মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গেলে কিশোর সিরাজ তার নানার যুদ্ধের সঙ্গী হন। আলীবর্দী খান সিরাজকে বালক বয়সেই পার্টনার শাসণকর্তা হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। তখন সিরাজের বয়স খুবই অল্প থাকার কারনে রাজা জানকি রামকে রাজপ্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু বিষয়টি সিরাজউদ্দৌলাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি তাই তিনি একদিন গোপনে কয়েকজন বিষস্ত অনুচরকে সঙ্গেনিয়ে ভ্রমণের নাম করে স্ত্রী লুৎফন্নেসাকে সঙ্গে নিয়ে মুর্শীদাবাদ থেকে বের হয়ে পড়েন। বিনা অনুমতিতে জানকি রাম তার ক্ষমতা ছেড়ে দিতে অস্বীকার করেন। দুর্গের দ্বার বন্ধ করে বৃদ্ধ নবাবের কাছে বিস্তারিত তথ্য জানিয়ে দূত পাঠান জানকি রাম। অন্য দিকে জানকি রামের আচরনে ক্ষুব্দ হয়ে সিরাজউদ্দৌলা দূর্গে আক্রমন করেন। উভয় পক্ষে লড়াই শুরু হয়েগেলে হতাহতের ঘটনাও ঘটে। ঘটনার সংবাদ পেয়ে আলীবর্দী খান দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেন। সেদিন দুর্গের অভন্তরের দরবারে বসে আলীবর্দী খান তার স্নেহভাজন দৌহিদ্র সিরাজকে পাশে বসিয়ে দরবারে ঘোষণা দেন যে, আমার পরবর্তীতে বাংলা, বিহার ও উরিষ্যার মসনদে বসবে সিরাজ। ইতিহাসের এই ঘটনাকে সিরাজউদ্দৌলার যৌব রাজ্যাভিশেক বলে অভিহিত করা হয়। এই সময় সিরাজউদ্দৌলার বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর। তবে তার সিংহাসনের উত্তরাধিকার হিসেবে মনোনয়নের এই ঘটনা তার আত্মীবর্গরা মেনেনিতে পারেনি। অনেকেই তার বিরোধীতা শুরু করেন। এদের মধ্যে ছিলেন আলীবর্দী খান এর বড় মেয়ে ঘষেটি বেগম এবং তার স্বামী নোয়াজেস মোহাম্মদ।
• এছাড়াও আলীবর্দী খানের জীবদ্দশায় সিরাজউদ্দৌলা ঢাকার নৌবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
• অবশেষে ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল তার নানা আলীবর্দী খান মৃত্যুবরন করেন। সেই সময় এক দূর্যোগময় অবস্থায় নবাব সিরাজউদ্দৌলা নবাব হিসেবে সিংহাসনে আরহন করেন।
• সিরাজউদ্দৌলা যখন সিংহাসনে আরহন করেন তখন থেকেই কোলকাতায় ইংরেজদের প্রাদুর্ভাব ধীরে ধীরে বারতে থাকে। তিনি ইংরেজদের দমন করার জন্য কাসেম বাজারের পুঠিয়াল ও ওয়াসনকে কোলকাতার দূর্গ প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলতে ও ভবিষ্যতে নবাবের পূর্বানুমতি ছাড়া এ ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে তার নির্দেশ দেন কিন্তু ইংরেজরা তার এই আদেশ অমান্য করে তাদের কাজ বহাল রাখে। নবাব তখন বুঝতে পারলেন ইংরেজরা তার গৃহ বিবাদের সুযোগ নিয়ে এ ধরনের কাজ করছে। সূতরাং প্রথমে তিনি ঘষেটি বেগমের চক্রান্তকে চূর্ণ করার জন্য সচেষ্ট হন। তিনি মতিঝিল প্রাসাদ অধিকার করে ঘষেটি বেগমকে মুর্শীদাবাদে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন। মতিঝিল অধিকার করে নবাব কাসিম বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হন। ২৭ মে তার সেনাবাহিনী কাসিম বাজারের দূর্গ অবরুদ করেন। তিনি কাসিম বাজারের কুঠিয়াল ও ওর্য়াশনকে তার দরবারে হাজির হয়ে তার নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করার জন্য অঙ্গীকার পত্র লেখতে বলেন। ওর্য়াশন এই অঙ্গিকার পত্র লেখতে বাধ্য হন। একই বছর ১৮ জুন সিরাজউদ্দৌলা কোলকাতা আক্রমন করেন। তুমুল যুদ্ধ হওয়ার পর ২০ জুন কলকাতা দূর্গ সিরাজের দখলে আসে। তিনি দরবারে প্রবেশ করেন এবং দরবারে উপবেশন করে উমিচাদ ও কৃষ্ণবল্লবকে দরবারে উপস্থিত হওয়ার আদেশ দেন। এর পর সেনাপতি মানিকচাদের হাতে দূর্গের শাসণভার ছেড়ে দিয়ে সিরাজউদ্দৌলা রাজধানীতে ফিরে আসেন। ১২ জুলাই তিনি রাজধানীতে প্রতার্বন করেন। এরপর দিল্লীর বাদশা পূর্ণিয়ার নবাব সওকত জংকে বাংলা, বিহার ও উরিষ্যার নবাবী সনদ পাঠান। সওকত জং নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা আয়োজন করেন। ইংজেরা এই সংবাদ পেয়ে গোপনে সওকত জং এর সাথে মিত্রতা করার চেষ্টা করতে থাকে। অপর দিকে মাদ্রাজের ইংজের দরবার কর্ণেল রবার্ট ক্লাইভকে প্রধান সেনাপতি করে কলকাতা পুনরুদ্ধারের জন্য পাঠিয়ে দেন। সিরাজউদ্দৌলা শওকত জংকে প্রতিরোধ করার জন্য রওয়ানা হন। পথিমধ্যে নবাবগঞ্জ নামক স্থানে উভয় পক্ষ মুখোমুখি যুদ্ধে লিপ্ত হন। যুদ্ধে শওকত নিহত হন। সিরাজউদ্দৌলা মোহন লালের হাতে পূর্ণিয়ার শাসনভার অর্পন করে রাজধানীতে ফিরে আসেন। ক্লাইভ ও ওয়াটসন পোলতায় পৌছেই কলকাতা অভিমুখে রওনা হয়। প্রায় বিনাযুদ্ধে তারা কলকাতা জয় করে নেন। এর আগে ক্লাইভ ও ওয়াটসন কলকাতায়ে এসে সিরাজউদ্দৌলার কাছে সন্ধির প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন এবং সিরাজউদ্দৌলা তাতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু ইংরেজরা শর্ত ভঙ্গ করে কলকাতা আক্রমন করে। সিরাজউদ্দৌলা তার মন্ত্রীদের কুচক্রের বিষয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। তাই ইংরেজদের প্রায় সকল প্রকার দাবিতে স্বীকার হয়ে ১৭৫৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারী একটি সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করেন। ইতিহাসে এই সন্ধি আলিনগরের সন্ধি নামে পরিচিত। কিন্তু ইংরেজরা তাদের মতিগতির কোন পরিবর্তন করল না। মূলত তাদের প্রতিদ্বদিতা ছিল ফরাসিদের সাথে। কিন্তু সিরাজউদ্দৌলা ফরাসিদের বেশি প্রাধান্য দিচ্ছিলেন। আলিনগরের সন্ধি পালনের জন্য নবাবকে যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল। সব ধরনের গোলমাল মোটামুটি শান্ত হওয়ার পর। নবাব সেনাপতিদের অপকর্মের বিচার শুরু করেন। মানিকচন্দ্রকে কারাবন্দি করা হয়। এটা দেখে রাজবল্লব, জগৎশেঠ ও মীরজাফর সবাই ভীত হয়ে পড়েন। স্বার্থ রক্ষার জন্য জগৎশেঠের মন্ত্রনাভবনে মিলিত হয়ে তারা ইংরেজদের সাথে হাত মিলিয়ে নবাবকে সিংহাসন চ্যুত্ত করে মীরজাফরকে সিংহাসনে বসানোর চক্রান্ত করে। ইয়ার লতিফ গোপনে ওয়াটসনের সাথে মিলিত হয়ে কুমন্ত্রণা দিলেন যে, সিরাজউদ্দৌলা খুব সহজেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন। আর এ কারনেই তিনি পলাশীতে শিবির স্থাপন করেছেন। ক্লাইভ এর পর তার সেনাবাহিনীর অর্ধেক লুকিয়ে রেখে বাকিদের নিয়ে কলকাতায় পৌছালেন। আর নবাবকে পত্র লিখলেন আমরা সেনাদল উঠিয়ে আনলাম আর আপনি পলাশিতে ছাউনি গেড়ে বসে রইলেন। নবাব সরল বিশ্বাসেই মীরজাফরকে ছাউনি তুলে মুর্শিদাবাদে যাওয়ার আদেশ দিলেন। মীরজাফর রাজধানীতে পৌছা মাত্রই ক্রাফটন তার সাথে মিলিতি হয়ে গোপনে সন্ধির খসড়া লিখে নিলেন। ১৭ মে কলকাতার ইংরেজদের দরবারে এই গোপন সন্ধিপত্রে খসড়া নিয়ে আলোচনা হয়। মীরজাফরের স্বাক্ষরের জন্য ১০ জুন তার কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু এই গুপ্ত বৈঠক আর গোপন থাকলনা। ক্লাইভ যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া শুরু করলেন। এদিকে গোপনে সন্ধি পত্রের সংবাদ জানতে পেয়ে সিরাজউদ্দৌলা মীরজাফরকে বন্দী করার ব্যবস্থা নিলেন। অন্যদিকে ওয়াটসন রাজধানী থেকে পালিয়ে গেল। অবশেষে বেজে উঠল পলাশী যুদ্ধের দাবানল। ১৭৫৭ সালের ১২ই জুন কলকাতায় ইংরেজ সেনারা চন্দন নগরের সেনাবাহিনীর সাথে মিলিত হয়। সেখানে দুর্গ রক্ষার জন্য অল্প কিছু সৈন্য রেখে তারা ১৩জুন অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ যাত্রা শুরু করে। কলকাতা থেকে মুর্শীদাবাদের পথে হুগলি, কাটোয়ার দূর্গ, অগ্রদ্বীপ নবাবের সৈন্য থাকা সত্ত্বেও তারা কেউ ইংরেজদের পথরোধ করলনা। নবাব বুজতে পারলেন সেনাপতিরাও এই ষড়যন্ত্রে সামিল। বিদ্রোহের আভাস পেয়ে নবাব মীরজাফরকে বন্দী করার চিন্তা বাদ দিলেন এবং মীরজাফরকে ক্ষমা করে তাকে শপথ নিতে বললেন। মীরজাফর পবিত্র কোরআন ছুয়ে শপথ করে অঙ্গিকার করলেন যে তিনি শরীরে এক বিন্দু রক্ত থাকতেও বাংলার স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন হতে দিবেন না। গৃহ বিবাদের মিমাংশা করে তিনি রায় দুর্লভ, ইয়ার লতিফ, মীরজাফর, মীর মদন, মোহন লাল ও ফরাসি সেনাপতি সিনফ্রে কে সৈন্য চালানোর দ্বায়িত্ব দিয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ যাত্রা শুরু করলেন। ২৩ জুন সকাল থেকেই পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজরা মুখোমুখি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হল। ইংরেজরা লক্ষবাদ নামক আমবাগানে সৈন্য সমাবেশ করল। বেলা ৮টার সময় হঠাৎ করেই মীর মদন ইংরেজ বাহিনীকে আক্রমন করেন। তার প্রবল আক্রমনে টিকতে না পেরে ক্লাইভ তার সেনাবাহিনী নিয়ে আমবাগানে আশ্রয় নেয়। ক্লাইভ কিছুটা বিচলিত হয়ে পরেন। মীর মদন ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিলেন। কিন্তু মীরজাফর, ইয়ার লতিফ ও রায় দুর্লভ যেখানে সৈন্য সমাবেশ করেছিলেন সেখানেই দাড়িয়ে রইলেন। তাদের সামান্য সহায়তা পেলেও হয়তো মীর মদন ইংরেজদের পরাজয় বরণ করতে বাধ্য করতে পারতেন। দুপুরের দিকে হঠাৎ বৃষ্টি নামলে নবাবের গোলাবারুদ ভিজে যায়। তবুও সাহসী মীরমদন ইংরেজদের সাথে লড়াই চালাতে থাকেন। কিন্ত হঠাৎ করেই গোলার আঘাতে মীরমদন মৃত্যুবরণ করেন। মীর মদনের মৃত্যুর পরেও অন্যতম সেনাপতি মোহন লাল যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। তিনি যুদ্ধ বিরুধীদের বিরুদ্ধে গিয়ে ইংরেজ বাহিনীকে আক্রমনের পক্ষে পক্ষপাতি ছিলেন। কিন্তু মীরজাফর আবারও বিশ্বাস ঘাতকতা করে তার সৈন্য বাহিনীকে শিবিরে ফিরে যাবার নির্দেশ দেন। এই সুযোগ নিয়ে ইংরেজরা নবাবকে আক্রমন করে। যুদ্ধ বিকাল ৫ টায় শেষ হয় এবং নবাবের ছাউনি ইংরেজদের দখলে আসে। ইংরেজদের পক্ষে ৭ জন ইউরোপিয়ান এবং ১৬ জন দেশিও সৈন্য নিহত হয়। তখন কোন উপায় না দেখে নবাব রাজধানী রক্ষার জন্য দুই হাজার সৈন্য নিয়ে মুর্শীদাবাদের উদ্দেশ্যে রেওনা হন। কিন্তু রাজধানী রক্ষার জন্য কেউ তাকে সাহায্য করেনি। নবাব তার স্ত্রী ও ভৃত্য গোলাম হোসেনকে নিয়ে রাজধানী থেকে বের হয়ে স্থল পথে ভগবানগোলায় পৌছে যায়। এবং সেখান থেকে নৌকা যোগে পদ্মা ও মহান্দার মধ্য দিয়ে উত্তর অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। তার আশা ছিল পশ্চিমাঞ্চলে পৌছাতে পারলেই ফরাসি সৈনিক মসিয়েনাস এর সহায়তায় পার্টনা পর্যন্ত গিয়ে রামনারায়নের কাছ থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে ফরাসি বাহিনীর সহয়তায় বাংলাকে রক্ষা করবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নবাবের এই আশা বাস্তবে রূপ লাভ করতে পারেনি। মীর জাফর রাজধানীতে পৌছে। নবাবকে খুজে না পেয়ে চারিদিকে লোক পাঠালেন। ১৭৫৭ সালের ৩ জুলাই নবাব মহন্দা নদীর স্রোত অতিক্রম করে এলেও জোয়ারভাটার ফলে জল কমে যাওয়ায় নদীর মোহনায় এসে তার নৌকা আটকে যায়। তিনি নৌকা থেকে নেমে খাবার সংগ্রহের জন্য একটি মসজিদের নিকটবর্তী বাজারে চলে আসেন। সেখানে কিছু লোক তাকে চিনে ফেলে অর্থে লোভে মীরকাশিমের সৈন্য বাহিনীকে খবর দেন। এ সম্পর্কে ভিন্ন আর একটি মত আছে যে, এক ফকির নবাবকে দেখে চিনে ফেলে। ইতোপূর্বে ঐ ফকির নবাব কর্তৃক শাস্তি পেয়ে তার একটি কান হারিয়ে ফেলেছিল। এই ফকিরই সৈন্য বাহিনীকে খবর দেয় এবং সৈন্যরা এসে নবাবকে বন্দি করে মুর্শীদাবাদে পাঠিয়ে দেয়। বন্দী হবার সময় নবাবের সাথে ছিলেন তার স্ত্রী লুৎফুন্নেসা বেগম এবং চার বছর বয়সী শিশু কন্যা উম্মে জহুরা। এর পরের দিন ৪ জুলাই মতান্তরে ৩ জুলাই মীরজাফরের আদেশে তার পুত্রের তত্ত্বাবধানে মহাম্মদীবেগ নামের এক ঘাতক নবাবকে হত্যা করে। কথিত আছে নবাবের মৃত্যুর পর তার মৃত দেহ হাতির পিঠে চড়িয়ে সারা শহর ঘোড়ানো হয়। মুর্শীদাবাদের খোশবাগে নবাব আলীবর্দী খানের কবরের পাশে বাংলা, বিহাড় উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।