- Tue Apr 28, 2020 5:57 pm#2562
পূর্বেউল্লেখিত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ(১৯১৪-১৯১৮খ্রিঃ) চলাকালীন সময়ে বর্তমান সৌদি রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দুটি প্রদেশ ছিল নজদ এবং হিজাজ। এই প্রদেশ দুইটিতে যথাক্রমে নজেদের রিয়াদ আমিরাতে সৌদি রাজবংশ এবং হাইল আমিরাত রশিদিয় রাজবংশ অপরদিকে হিজাজে তথা মক্কা-মদীনা শাসন করছিল মক্কার শরিফরা। এদের মধ্যে নজদের রশিদিয় এবং মক্কার শরিফরা ছিল উসমানীয় সাম্রাজ্যের অনুগত। কিন্তু ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন লরেন্সের য়ড়যন্ত্রের কবলে পড়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সৌদিরা উসমানীয়দের অর্থাৎ অক্ষ শক্তির বিপক্ষে হয়ে ব্রিটেন তথা মিত্র শক্তির পক্ষে যোগদান করে।
পরবর্তীতে একই ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে হিজাজের শাসক হুসাইন বিন আলী ও উসমানীয়দের বিরুদ্ধে গিয়ে আরব বিদ্রোহ ঘোষণার মাধ্যমে ব্রিটেনের পক্ষে যোগ দেয়।
ব্রিটিশ সামরিক অফিসার টি.ই. লরেন্সের প্রত্যক্ষ পরিচালনায়, বিশ্বাসঘাতক হুসাইন মিডল-ইস্টার্ন ফ্রন্টে উসমানীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলে বহু উসমানীয় সৈন্য নিহত এবং বন্দী হয়। ফলশ্রুতীতে উসমানীয়রা মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটিশ তথা মিত্র শক্তির নিকট পরাজিত হয়। এমনকি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানীয় তথা অক্ষ শক্তির পরাজিত হওয়ার পিছনে উক্ত মক্কার শরিফ তথা হেজাজের বাদশাহ হুসাইন বিন আলির নেতৃত্বে আরব বিদ্রোহের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
অবশেষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অক্ষ শক্তী তথা উসমানীয়রা পরাজিত হয়। এর ফলে ১৩০০ বছর পর মুসলিম খিলাফতের পতন ঘটে। এমনকি এই সময় জেরুজালেমও মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যায়। খ্রিস্টানরা জেরুজালেম দখল করে পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুসারে ইহুদিদের হাতে তা ছেড়ে দেয়। অর্থাৎ তৃতীয় থেকে দশম ক্রুসেড যা পরেনি, এ একাদশ ক্রুসেড সেটি সম্পন্ন করল। যদিও আবেসিনিয়ার খ্রিস্টান শাসক নাজ্জাসির মত মক্কা-মদীনা দখলের সাহস ব্রিটিশরা করেনি। অতঃপর মুসলিম বিশ্বে নেমে আসে ঘোর অমানিশা।
যুদ্ধে ব্রিটেন এবং তাদের অনুগত নজদের সৌদি ও হিজাজের শরিফদের জয়ের পর এবার প্রশ্ন থেকে যায়, মুসলমানদের পবিত্র ভূমি মক্কা-মদীনা নিয়ে। কেননা উক্ত দুই পক্ষই ব্রিটেনের মিত্র ছিল। বিশেষ করে সৌদিদের মনোবাসনা ছিল হিজাজ দখল করে মক্কা-মদীনায় আধিপত্য বিস্তার করা। কিন্তু ব্রিটিশরা বিশ্বাসঘাতকতার পুরস্কার স্বরুপ হুসাইন বিন আলীকে হেজাজ তথা মক্কা,মদীনা,তায়েফ এবং জেদ্দার শাসক হিসেবে মনোনিত করে। সৌদিদের নজদের শাসক হিসেবে অধিষ্টিত রাখে। এভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সৌদিদের কিছুটা বেকায়দায় ফেলে দেয়।
ব্রিটিশদের এই ক্ষমতা বন্টনের মাঝে রোপিত ছিল সুস্পষ্ট সংঘাতের বীজ। কেননা মক্কা-মদীনার কতৃত্বকে কেন্দ্র করে উভয় পক্ষের মাঝে যে ভবিষ্যৎ-এ সংঘর্ষ অনিবার্য তা তারা সবারি জানা ছিল। এ যেন আরেক ফিলিস্তিন কিংবা কাশ্মীর সংকটের প্রতিচ্ছবি। যুদ্ধের পর ব্রিটিশরা আব্দুল আযীয আস সৌদকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উদ্বৃত্ত বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ এবং যুদ্ধ-সরান্জম দিয়ে দেয়।
১৯১৮ সালে যুদ্ধ শেষে হেজাজের শাসক হুসাইন বিন আলী এবং নজদের রিয়াদ আমিরাতের শাসক আব্দুল আজিজ আস সাউদ ব্রিটিশদের সমর্থনপুষ্ট হয়ে নিজেদের রাজ্যে শাসন কার্য পরিচালনা করতে থাকে। হেজাজের শাসক সম্পূর্ণভাবে ব্রিটিশদের অর্থ ও সাহায্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কিন্তু সৌদি শাসক ব্রিটিশদের সাহায্য গ্রহণ করলেও ওয়াহাবী মতাদর্শদের নিয়ে গঠিত ”ইখওয়ান” নামের সেনাবাহিনীর ধর্মীয় যুদ্ধাদের সুসংবদ্ধ এবং একত্রিত করতে থাকেন।
আপাততে আস সউদ ব্রিটিশদের কারণে হেজাজ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখলেও সমগ্র নজদ দখল করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কেননা তখনো উসমানীয় সমর্থীত রশিদিয়রা নজদের হাইল আমিরাত শাসন করে আসছিল। যদিও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের শক্তি ক্ষীণ হয়ে যাই। অবশেষে ইখওয়ান সেনাবাহিনীর সাহায্যে সমগ্র নজদ এবং আরব উপদ্বেীপের অন্যন্য অঞ্চল অধিকার করার জন্য অভিযান প্রেরণ করেন। ইখওয়ানের প্রধান প্রধান নেতা ছিলেন যথাক্রমে সুলতান বিন বাজাদ আল উতাইবি এবং ফয়সাল আল দাউয়িশ।
১৯২০ সালের আগস্ট মাসে ইখওয়ানদের সহয়তায় হেজাজ ও ইয়ামেনের মধ্যবর্তী অঞ্চল আসির দখল করেন এবং ১৯২১ সালের নভেম্বরে রশিদিয়দের হাইল আমিরাতের প্রধান কেন্দ্র হাইল দখল করেন। এর ফলে একদিকে সমগ্র নজদ তথা উত্তর আরব সৌদি শাসক আস সৌদের অধীনে চলে আসে। অপরদিকে রশিদিয়রা পরাজিত হয়ে বিভিন্ন দেশে নির্বাসিত হয়। এবং তাদের শাসনকাল মূলত এখানেই ইতি ঘটে।
আব্দুল আযীয আস সৌদ এবার হেজাজ অধিকর করার জন্য সুযোগ খুজছিলেন। হেজাজের শাসকের চেয়ে যথেষ্ট শক্তি-সামর্থ থাকার পরও ১৯২৩ সালে আস সউদ হেজাজ আক্রমণের ঝুঁকি নেননি। কারণ হেজাজের শাসক মক্কার শরিফ হোসেন বিন আলীকে ব্রিটেন সমর্থন করেছিলেন। আর উভয় পক্ষয় ব্রিটেনের সাথে আর্থিক ও অন্যন্য সূত্রে আবদ্ধ ছিল। কিন্তু ব্রিটিশদের ক্ষিপ্ত হওয়ার সম্ভবনা সত্ত্বেও উচ্চকাঙ্ক্ষী হেজাজের শাসক হোসেন ১৯২৪ সালে মার্চ মাসে নিজেকে মুসলমানদের বলে খলিফা ঘোষণা করেন। এর ফলে ব্রিটিশরা হোসেনের প্রতি ক্ষুদ্ধ হয়ে তার থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে।
এ যুযোগটি কাজে লাগায় সৌদি শাসক আস সউদ। তিনি কালবিলম্ব না করে ইখওয়ান সেনাবাহিনীর সহায়তায় হেজাজে অভিযান পরিচালনা করে ১৯২৪ সালের আগস্টে হেজাজের তায়েফ শহর অধিকার করেন। একই বৎসর অক্টোবর মাসে ৩ তারিখ হেজাজের শাসক হোসাইন বিন আলি তার জ্যৈষ্ঠ পুত্র আলীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করেন।
এরপর সৌদি এবং ইখওয়ান তথা মুসলিম ব্রাদরহুডদের সম্মিলিত শক্তির কাছে মক্কার শরিফরা ঠিকতেই পারলনা। অতঃপর এই সমিল্লিত জোট পর্যায়ক্রমে ১৯২৪ সালের ১৩ অক্টোবর মক্কা শহর এবং ১৯২৫ সালের ৫ ডিসেম্বরে মদীনা অধিকার করে। অবশেষে একই বৎসরের ‘৯ ডিসেম্বর মক্কার শরীফ বংশের শেষ শাসক আলী পদত্যাগ করলে আব্দুল আযীয আস সৌদ জেদ্দা দখল করে। এর মাধ্যমে নজদের রশিদিয় বংশের মত, হেজাজের শরিফদের ও পতন ঘটে।
এইভাবে সমগ্র হেজাজ দখল করার পর ১৯২৬ সালের জানুয়ারি মাসের ৮ তারিখে আব্দুল আযীয আস সাউদ হেজাজের বাদশাহ এবং নজদের সুলতান(পূর্বপ্রথা অনুযায়ী) উপাধিতে ভূষিত হন। এর চার মাস পর বৃটিশরা জেদ্দা চুক্তির মাধ্যমে হেজাজকে স্বাধীনতার স্বীকৃতি প্রদান করে। যার ফলে সৌদিরা নজদ ও হেজাজের একচ্ছত্র অধিপতি হয়। এবং পরবর্তী ৫ বছর আব্দুল আযীয আস সউদ তার দুই রাজত্ব তথা হেজাজ ও নজদকে আলাদা রেখেই শাসন করে।
অতপর সৌদি রাজবংশের উত্থানের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে যারা ছিল, সবাইকে পরজিত করে সৌদিরা নিজেদের অবস্থানকে পাকাপুক্ত করে শান্তিতে বসবাস করতে শুরু করে। কিন্তু তাদের শান্তি বেশিদিন স্থায়ী হল না। কিছু মতানৈক্যের কারণে ইখওয়ানদের সাথে সৌদি রাজবংশের সংঘাত শুরু হয়। ইখওয়ান এবং সৌদিদের মাঝে সংঘাতের পেছনে উল্ল্যেখযোগ্য কিছু কারণ ছিল। তার মধ্যে অন্যতম হলো-
ইখওয়ান নেতারা ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণাধীন ট্রান্সজর্ডান, ইরাক এবং কুয়েতে ওয়াহাবি রাজ্যের সম্প্রসারণ অব্যাহত রাখতে চেয়েছিলেন। তবে আবদুল আজিজ ব্রিটিশদের সাথে সরাসরি বিরোধের বিপদের আশঙ্কায় এটিতে একমত হতে অস্বীকার করেন। তাছাড়া ব্রিটিশদের ইখওয়ান তথা ভ্রাতৃত্ব সংঘের ইসলামিক কার্যকলাপকে সহজে গ্রহণ করতে পারত না। এক কথায় তাদের কর্মকান্ড ব্রিটিশ বিরুধি হওয়ায়, সৌদি রাজা আব্দুল আযীয আস সউদ ইখওয়ানদের এড়িয়ে যেতে থাকে। কেননা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মত শক্তি সৌদিদের ছিলনা।
অবশেষে সৌদিদের সাথে মতানৈক্যের ফলে ইখওয়ানারা বিদ্রোহী হয়ে উঠলে ১৯২৯ সালে উভয় পক্ষের মধ্যে সাবিলার যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে ব্রিটিশ সমর্থীত সৌদিদের হাতে ইখওয়ানরা পরাজিত হয় এবং তাদের নেতৃত্বের যবানিকপাত ঘটে। ইখওয়ানদের পতনের পর, সৌদিরা এক শক্তিশালী সেনাবহিনী গঠন করে এবং ব্রিটিশদের সহযোগিতায় তাদের আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জ্বিত করে।
এরপর ইরাক,কুয়েত,ইয়ামেন এবং ট্রান্স জর্ডানের সাথে বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে সৌদিরা তাদের রাষ্ট্রের সীমানা নির্ধারণ করে। অবশেষে ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আব্দুল আযীয আস সউদ তার দুই রাজত্ব অর্থাৎ হেজাজ ও নজদকে একত্রিত করেন। অতপর সৌদি রাজবংশের পূর্বপুরুষ মুহাম্মদ বিন সৌদের নামনুসারে ”সৌদি আরব” নামকরণ করেন।
২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে এ মর্মে রাজকীয় ফরমান জারি হয় যে, এখন থেকে অধিকৃত আরব অঞ্চল ‘আল মামলাকাতুল আরাবিয়্যা আস-সাউদিয়্যাহ’, ‘কিংডম অব সৌদি আরবিয়া’অর্থাৎ সৌদি আরব রাজবংশ সংক্ষেপে সৌদি আরব নামে পরিচিতি লাভ করবে। এর পর থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর সৌদি আরবের জাতীয় দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। যাই হোক, সৌদি আরবের ইতহাসের প্রাধান্য এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত।
কিন্তু ৮০ বছরেরও বেশি সময় আগে ১৯৩৮ সালের মার্চ মাসে সৌদি আরবে প্রথম তেল খনির সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। এর পর থেকে সৌদি আরব হয়ে উঠে আন্তর্জাতিক ইতিহাসের কেন্দ্র স্থল। যেমনটা দেশটি ভৌগলিক দিক দিয়ে পৃথিবীর কেন্দ্রে অবস্থিত।[চলমান………]
==================================
মো: এমরান হোছাইন।
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ,চ.বি।
পরবর্তীতে একই ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে হিজাজের শাসক হুসাইন বিন আলী ও উসমানীয়দের বিরুদ্ধে গিয়ে আরব বিদ্রোহ ঘোষণার মাধ্যমে ব্রিটেনের পক্ষে যোগ দেয়।
ব্রিটিশ সামরিক অফিসার টি.ই. লরেন্সের প্রত্যক্ষ পরিচালনায়, বিশ্বাসঘাতক হুসাইন মিডল-ইস্টার্ন ফ্রন্টে উসমানীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলে বহু উসমানীয় সৈন্য নিহত এবং বন্দী হয়। ফলশ্রুতীতে উসমানীয়রা মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটিশ তথা মিত্র শক্তির নিকট পরাজিত হয়। এমনকি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানীয় তথা অক্ষ শক্তির পরাজিত হওয়ার পিছনে উক্ত মক্কার শরিফ তথা হেজাজের বাদশাহ হুসাইন বিন আলির নেতৃত্বে আরব বিদ্রোহের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
অবশেষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অক্ষ শক্তী তথা উসমানীয়রা পরাজিত হয়। এর ফলে ১৩০০ বছর পর মুসলিম খিলাফতের পতন ঘটে। এমনকি এই সময় জেরুজালেমও মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যায়। খ্রিস্টানরা জেরুজালেম দখল করে পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুসারে ইহুদিদের হাতে তা ছেড়ে দেয়। অর্থাৎ তৃতীয় থেকে দশম ক্রুসেড যা পরেনি, এ একাদশ ক্রুসেড সেটি সম্পন্ন করল। যদিও আবেসিনিয়ার খ্রিস্টান শাসক নাজ্জাসির মত মক্কা-মদীনা দখলের সাহস ব্রিটিশরা করেনি। অতঃপর মুসলিম বিশ্বে নেমে আসে ঘোর অমানিশা।
যুদ্ধে ব্রিটেন এবং তাদের অনুগত নজদের সৌদি ও হিজাজের শরিফদের জয়ের পর এবার প্রশ্ন থেকে যায়, মুসলমানদের পবিত্র ভূমি মক্কা-মদীনা নিয়ে। কেননা উক্ত দুই পক্ষই ব্রিটেনের মিত্র ছিল। বিশেষ করে সৌদিদের মনোবাসনা ছিল হিজাজ দখল করে মক্কা-মদীনায় আধিপত্য বিস্তার করা। কিন্তু ব্রিটিশরা বিশ্বাসঘাতকতার পুরস্কার স্বরুপ হুসাইন বিন আলীকে হেজাজ তথা মক্কা,মদীনা,তায়েফ এবং জেদ্দার শাসক হিসেবে মনোনিত করে। সৌদিদের নজদের শাসক হিসেবে অধিষ্টিত রাখে। এভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সৌদিদের কিছুটা বেকায়দায় ফেলে দেয়।
ব্রিটিশদের এই ক্ষমতা বন্টনের মাঝে রোপিত ছিল সুস্পষ্ট সংঘাতের বীজ। কেননা মক্কা-মদীনার কতৃত্বকে কেন্দ্র করে উভয় পক্ষের মাঝে যে ভবিষ্যৎ-এ সংঘর্ষ অনিবার্য তা তারা সবারি জানা ছিল। এ যেন আরেক ফিলিস্তিন কিংবা কাশ্মীর সংকটের প্রতিচ্ছবি। যুদ্ধের পর ব্রিটিশরা আব্দুল আযীয আস সৌদকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উদ্বৃত্ত বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ এবং যুদ্ধ-সরান্জম দিয়ে দেয়।
১৯১৮ সালে যুদ্ধ শেষে হেজাজের শাসক হুসাইন বিন আলী এবং নজদের রিয়াদ আমিরাতের শাসক আব্দুল আজিজ আস সাউদ ব্রিটিশদের সমর্থনপুষ্ট হয়ে নিজেদের রাজ্যে শাসন কার্য পরিচালনা করতে থাকে। হেজাজের শাসক সম্পূর্ণভাবে ব্রিটিশদের অর্থ ও সাহায্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কিন্তু সৌদি শাসক ব্রিটিশদের সাহায্য গ্রহণ করলেও ওয়াহাবী মতাদর্শদের নিয়ে গঠিত ”ইখওয়ান” নামের সেনাবাহিনীর ধর্মীয় যুদ্ধাদের সুসংবদ্ধ এবং একত্রিত করতে থাকেন।
আপাততে আস সউদ ব্রিটিশদের কারণে হেজাজ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখলেও সমগ্র নজদ দখল করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কেননা তখনো উসমানীয় সমর্থীত রশিদিয়রা নজদের হাইল আমিরাত শাসন করে আসছিল। যদিও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের শক্তি ক্ষীণ হয়ে যাই। অবশেষে ইখওয়ান সেনাবাহিনীর সাহায্যে সমগ্র নজদ এবং আরব উপদ্বেীপের অন্যন্য অঞ্চল অধিকার করার জন্য অভিযান প্রেরণ করেন। ইখওয়ানের প্রধান প্রধান নেতা ছিলেন যথাক্রমে সুলতান বিন বাজাদ আল উতাইবি এবং ফয়সাল আল দাউয়িশ।
১৯২০ সালের আগস্ট মাসে ইখওয়ানদের সহয়তায় হেজাজ ও ইয়ামেনের মধ্যবর্তী অঞ্চল আসির দখল করেন এবং ১৯২১ সালের নভেম্বরে রশিদিয়দের হাইল আমিরাতের প্রধান কেন্দ্র হাইল দখল করেন। এর ফলে একদিকে সমগ্র নজদ তথা উত্তর আরব সৌদি শাসক আস সৌদের অধীনে চলে আসে। অপরদিকে রশিদিয়রা পরাজিত হয়ে বিভিন্ন দেশে নির্বাসিত হয়। এবং তাদের শাসনকাল মূলত এখানেই ইতি ঘটে।
আব্দুল আযীয আস সৌদ এবার হেজাজ অধিকর করার জন্য সুযোগ খুজছিলেন। হেজাজের শাসকের চেয়ে যথেষ্ট শক্তি-সামর্থ থাকার পরও ১৯২৩ সালে আস সউদ হেজাজ আক্রমণের ঝুঁকি নেননি। কারণ হেজাজের শাসক মক্কার শরিফ হোসেন বিন আলীকে ব্রিটেন সমর্থন করেছিলেন। আর উভয় পক্ষয় ব্রিটেনের সাথে আর্থিক ও অন্যন্য সূত্রে আবদ্ধ ছিল। কিন্তু ব্রিটিশদের ক্ষিপ্ত হওয়ার সম্ভবনা সত্ত্বেও উচ্চকাঙ্ক্ষী হেজাজের শাসক হোসেন ১৯২৪ সালে মার্চ মাসে নিজেকে মুসলমানদের বলে খলিফা ঘোষণা করেন। এর ফলে ব্রিটিশরা হোসেনের প্রতি ক্ষুদ্ধ হয়ে তার থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে।
এ যুযোগটি কাজে লাগায় সৌদি শাসক আস সউদ। তিনি কালবিলম্ব না করে ইখওয়ান সেনাবাহিনীর সহায়তায় হেজাজে অভিযান পরিচালনা করে ১৯২৪ সালের আগস্টে হেজাজের তায়েফ শহর অধিকার করেন। একই বৎসর অক্টোবর মাসে ৩ তারিখ হেজাজের শাসক হোসাইন বিন আলি তার জ্যৈষ্ঠ পুত্র আলীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করেন।
এরপর সৌদি এবং ইখওয়ান তথা মুসলিম ব্রাদরহুডদের সম্মিলিত শক্তির কাছে মক্কার শরিফরা ঠিকতেই পারলনা। অতঃপর এই সমিল্লিত জোট পর্যায়ক্রমে ১৯২৪ সালের ১৩ অক্টোবর মক্কা শহর এবং ১৯২৫ সালের ৫ ডিসেম্বরে মদীনা অধিকার করে। অবশেষে একই বৎসরের ‘৯ ডিসেম্বর মক্কার শরীফ বংশের শেষ শাসক আলী পদত্যাগ করলে আব্দুল আযীয আস সৌদ জেদ্দা দখল করে। এর মাধ্যমে নজদের রশিদিয় বংশের মত, হেজাজের শরিফদের ও পতন ঘটে।
এইভাবে সমগ্র হেজাজ দখল করার পর ১৯২৬ সালের জানুয়ারি মাসের ৮ তারিখে আব্দুল আযীয আস সাউদ হেজাজের বাদশাহ এবং নজদের সুলতান(পূর্বপ্রথা অনুযায়ী) উপাধিতে ভূষিত হন। এর চার মাস পর বৃটিশরা জেদ্দা চুক্তির মাধ্যমে হেজাজকে স্বাধীনতার স্বীকৃতি প্রদান করে। যার ফলে সৌদিরা নজদ ও হেজাজের একচ্ছত্র অধিপতি হয়। এবং পরবর্তী ৫ বছর আব্দুল আযীয আস সউদ তার দুই রাজত্ব তথা হেজাজ ও নজদকে আলাদা রেখেই শাসন করে।
অতপর সৌদি রাজবংশের উত্থানের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে যারা ছিল, সবাইকে পরজিত করে সৌদিরা নিজেদের অবস্থানকে পাকাপুক্ত করে শান্তিতে বসবাস করতে শুরু করে। কিন্তু তাদের শান্তি বেশিদিন স্থায়ী হল না। কিছু মতানৈক্যের কারণে ইখওয়ানদের সাথে সৌদি রাজবংশের সংঘাত শুরু হয়। ইখওয়ান এবং সৌদিদের মাঝে সংঘাতের পেছনে উল্ল্যেখযোগ্য কিছু কারণ ছিল। তার মধ্যে অন্যতম হলো-
ইখওয়ান নেতারা ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণাধীন ট্রান্সজর্ডান, ইরাক এবং কুয়েতে ওয়াহাবি রাজ্যের সম্প্রসারণ অব্যাহত রাখতে চেয়েছিলেন। তবে আবদুল আজিজ ব্রিটিশদের সাথে সরাসরি বিরোধের বিপদের আশঙ্কায় এটিতে একমত হতে অস্বীকার করেন। তাছাড়া ব্রিটিশদের ইখওয়ান তথা ভ্রাতৃত্ব সংঘের ইসলামিক কার্যকলাপকে সহজে গ্রহণ করতে পারত না। এক কথায় তাদের কর্মকান্ড ব্রিটিশ বিরুধি হওয়ায়, সৌদি রাজা আব্দুল আযীয আস সউদ ইখওয়ানদের এড়িয়ে যেতে থাকে। কেননা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মত শক্তি সৌদিদের ছিলনা।
অবশেষে সৌদিদের সাথে মতানৈক্যের ফলে ইখওয়ানারা বিদ্রোহী হয়ে উঠলে ১৯২৯ সালে উভয় পক্ষের মধ্যে সাবিলার যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে ব্রিটিশ সমর্থীত সৌদিদের হাতে ইখওয়ানরা পরাজিত হয় এবং তাদের নেতৃত্বের যবানিকপাত ঘটে। ইখওয়ানদের পতনের পর, সৌদিরা এক শক্তিশালী সেনাবহিনী গঠন করে এবং ব্রিটিশদের সহযোগিতায় তাদের আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জ্বিত করে।
এরপর ইরাক,কুয়েত,ইয়ামেন এবং ট্রান্স জর্ডানের সাথে বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে সৌদিরা তাদের রাষ্ট্রের সীমানা নির্ধারণ করে। অবশেষে ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আব্দুল আযীয আস সউদ তার দুই রাজত্ব অর্থাৎ হেজাজ ও নজদকে একত্রিত করেন। অতপর সৌদি রাজবংশের পূর্বপুরুষ মুহাম্মদ বিন সৌদের নামনুসারে ”সৌদি আরব” নামকরণ করেন।
২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে এ মর্মে রাজকীয় ফরমান জারি হয় যে, এখন থেকে অধিকৃত আরব অঞ্চল ‘আল মামলাকাতুল আরাবিয়্যা আস-সাউদিয়্যাহ’, ‘কিংডম অব সৌদি আরবিয়া’অর্থাৎ সৌদি আরব রাজবংশ সংক্ষেপে সৌদি আরব নামে পরিচিতি লাভ করবে। এর পর থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর সৌদি আরবের জাতীয় দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। যাই হোক, সৌদি আরবের ইতহাসের প্রাধান্য এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত।
কিন্তু ৮০ বছরেরও বেশি সময় আগে ১৯৩৮ সালের মার্চ মাসে সৌদি আরবে প্রথম তেল খনির সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। এর পর থেকে সৌদি আরব হয়ে উঠে আন্তর্জাতিক ইতিহাসের কেন্দ্র স্থল। যেমনটা দেশটি ভৌগলিক দিক দিয়ে পৃথিবীর কেন্দ্রে অবস্থিত।[চলমান………]
==================================
মো: এমরান হোছাইন।
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ,চ.বি।