Page 1 of 1

সৌদি আরবের ইতিহাস(পর্ব-১): প্রাচীন থেকে বর্তমান

Posted: Mon Apr 20, 2020 12:07 am
by rekha
সৌদি আরব বর্তমান বিশ্বে ধর্মীয়,অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। বিশেষ করে ইসলামের পবিত্র ভূমি মক্কা-মদীনা দেশটিতে অবস্থিত হওয়ায় সারা বিশ্বের মুসলমানদের জন্য সৌদি আরব অত্যাধিক গুরুত্ব বহন করে। তাছাড়া ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দেশটিকে পৃথিবীর প্রাণ কেন্দ্রও বলা হয়। সৌদি আরব যেমন বৈচিত্রময় একটি দেশ, তেমনি এর ইতিহাস ও বেশ ডাল-পালা বিশিষ্ট।
তাই সৌদি আরবের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস সম্বন্ধে জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে সুদূর অতীতে। উল্লেখ্য, বর্তমান সৌদি আরবের ইতিহাসের সাথে তৎকালীন প্রাচীন আরব ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাছাড়া এই আরবের একটি অংশের উপর ভিত্তি করেই আধুনিক সৌদি রাষ্ট্রে উত্থান। প্রথমে প্রাচীন আবর এবং এর জনগোষ্ঠি সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করছি।
হযরত নূহ আঃ এর সময় এক মহাপ্লাবনের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্ব থেকে অবিশ্বাসীরা ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। মহাপ্লাবনের পরবর্তী কালে হযরত নূহ আঃ-এর চার পুত্র- সাম,হাম,ইয়াফাস এবং রাফেজের বংশধরগণ কালেক্রমে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে সাম-এর বংশধর অর্থাৎ সেমিটিকগণ আরবে বসবাস করতে শুরু করে। এবং পরবর্তীতে প্রাচীন আরবে তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন সভ্যতা ও নগরের গোড়াপত্তন হয়। আক্কাদীয়,আসিরীয়,ক্যালদীয়,ফিনিসীয় এবং হিব্র সভ্যতা এদের মধ্য অন্যতম।
কালের পরিক্রমায় সাম-এর বংশধর তথা সেমিটিক জাতীর মধ্য থেকে হযরত ইবরাহীম আঃ ও ইসমাঈল আঃ আল্লাহর নবী হিসেবে মনোনীত হন। এই ধারাবাহিকতায় ইসলামের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ ও ছিলেন সেমিটিক বংশের একজন। যিনি ছিলেন মদীনা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা , যা বর্তমান সৌদি আরবের একটি প্রধান শহর।
ভৌগোলিক দিক থকে সমগ্র আরবকে মোটামোটি তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:- উত্তর আরব, মধ্য আরব এবং দক্ষিণ আরব। এখানে হিযায,নজদ এবং আল আশা এই তিনটি প্রদেশ নিয়ে মধ্য আরব গঠিত। হিযাযের রাজধানী ছিলা মক্কা। মদীনা ও জেদ্দা ছিল হিযাযের আরও দুইটি প্রধান নগর। আর নজদ ছিল বর্তমান সৌদি বংশীয় বাদশাহাদের আদি জন্মভূমি।
রাজবংশ যাই হোকনা কেন,তা হয়তু একদিন বিলুপ্ত হয়ে অন্যে রাজবংশের সূচনা হবে। কিন্তু মুসলমানরা যে সৌদি রাষ্ট্রের কথা বিশ্বাস করে তার মূল ভিত্তি ছিল মহানবী সাঃ-এর প্রতিষ্টিত মদীনা রাষ্ট্র। সংক্ষেপে মদীনা রাষ্ট্রের পটভূমি আলোচনা করছি, ৬২২ খ্রিস্টাব্দে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত সংবিধান তথা মদীনা সনদ প্রণীত হলো। এর মাধ্যমে গঠিত হলো- পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ইসলামি রাষ্ট্র। এই সনদের প্রণেতা ছিলেন পৃথিবীর প্রথম মানব ও নবী হযরত আদম আঃ প্রবর্তীত ধর্ম ইসলামের শেষ নবী ,বিশ্ব মানবতার মুক্তির , সর্বশ্রেষ্ঠ মানব মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ। মদীনা সনদ প্রণয়নের উদ্দেশ্য ছিল সকল ধর্ম,বর্ণ ও জাতীর জন্য মদীনা রাষ্ট্রকে নিরাপদ ঘোষণা করা।
এখানে প্রণিধানযোগ্য যে, নিজের জন্মভূমি মক্কায় যখন কাফেরদের হাতে মহানবী সাঃ নির‌্যাতিত,নিপিড়ীত ছিলেন , ঠিক তখনি মদীনার ইহুদী,খ্রিস্টান গোত্র সমূহ নিজেদের মাঝে ঐক্যৈ প্রতিষ্টার লক্ষ্যে মহানবী সাঃ-কে মদীনায় আমন্ত্রণ জানান। মহান আল্লাহর অনুমতিক্রমে তিনি মদীনায় হিজরত করেন ৬২২ খ্রিস্টাব্দে। এবং ইহুদি খ্রিস্টানদের দেওয়া কথার ভিত্তিতে তিনি মদীনা সনদ প্রণয়ন করেন। যার মাধ্যমে মদীনায় শান্তি ও ঐক্যৈ প্রতিষ্টিত হয়।
মদীনা রাষ্ট্র প্রতিষ্টার পর সেখানে অনেক বছর অতিবাহিত করেন নাান প্রতিবন্ধকতার মাঝে। বিশেষ করে মক্কার কাফের,মদীনার ষড়যন্ত্রকারী ইহুদি এবং মোনাফিকদের কারণে মহানবী সাঃ কে অনেক কষ্টের স্বীকার করতে হয়েছে। মুসলমানদের এবং ইসলামী রাষ্ট্রকে তাদের হাত থেকে রক্ষার জন্য মহানবী সাঃ কে অনেক যুদ্ধ অংশগ্রহণ করতে হয়েছে। এবং তিনি অসংখ্য জয়ের কেতন উড়িয়েছিলেন আরবরে আকাশে।
কিন্তু মহানবীর সাঃ মন পড়ে থাকতো নিজ জন্মভূমি মক্কার কাছে। অবশেষে অপেক্ষার প্রহর গুণা শেষ হলো। মক্কার কাফেরদের অনবরত ষড়যন্ত্র,লুটপাত,হত্যা,রাহাজানি, চুক্তি ভঙ্গ ইত্যাদি কারণে মহানবী সাঃ মক্কা বিজয়ের জন্য মনঃস্থির করলেন। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে ১০ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে তিনি মক্কা বিজয়ে অগ্রসর হলেন। প্রতিমধ্যে দলে দলে যোগ দিতে লাগলো মহানবীর সাঃ দলে। এত বিশাল বাহিনী দেখে মক্কার কাফেররা ভয়ে কেউ পালিয়ে গেল আর কেউ কেউ আত্মসমর্পণ করলো।
মানবতার মুক্তির দিশারী মহানবী সাঃ ঘোষণা করলেন , শিশু,মহিলা,বৃদ্ধ আর যারা আত্মসমর্পণ করবে, তাদের কোন প্রকার আঘাত না করতে। অবশেষে বিনা যুদ্ধে, বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয় সম্পূর্ণ হলো। ইতিপূ্র্বে যে মক্কার কাফেররা তাকে অমানবিক নির‌্যাতন করেছিল,হত্যার ষড়যন্ত্র করে মক্কা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল তিনিই তাদের সবাইকে ক্ষমা ঘোষণা করলেন। এবং কাবার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ঘোষণা করলেন ““ওয়াকুল যা আল হাক্কু ওয়া যাহাকাল বাতিল। ইন্যাল বাতিলা কামা বাহুকা” অর্থাৎ ‘বল সত্য এসে গেছে, আর মিথ্যা বিলুপ্ত। মিথ্যাতো বিলুপ্ত হওয়ারই।’ (আল কুরআন, বনি ইসরাঈল-৮১)
মক্কা বিজয়ের পর মক্কা-মদীনা নিয়ে গঠিত হলো শক্তিশালী ইসলামী রাষ্ট্র। অতঃপর পথভ্রষ্ট মানবজাতীকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়ে ৬৩৩ খ্রিঃ পরলোক গমন করলেন মহানবী সাঃ। এর পর শুরু ইসলামের গণতন্ত্র ও স্বর্ণযুগ খ্যাত খিলাফতের শাসন। এর প্রথম শাসক কিংবা খলিফা হলেন হযরত আবু বকর রাঃ। এখানে জেনে রাখা ভালো, খিলাফত ছিল এমন একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যাবস্থা, যাতে দলপতিদের একটি পরিষদে ভোটের মাধ্যমে খলিফা নির্বাচিত হতেন।
৬৩৩ খ্রিঃ খলিফা নির্বাচিত আবু বকর রাঃ এই মদীনা কেন্দ্রিক রাষ্ট্রে থেকেই সিরিয়া ও বাহারায়নে ইসলামের পতাকা উড্ডিয়ন করলেন এবং পারস্যে অভিযান প্রেরণ করেন। ইসলামী সাম্রাজ্য আরও বিস্তিৃতি লাভ করলো এর রাজধানী মদীনা হলো জগৎ খ্যাত। ৬৩৪ খ্রিঃ আবু বকর রাঃ মৃত্যুবরণ করলে তাঁর স্থলাবিশিষ্ট হন- হযরত উমর রাঃ। তিনি খলিফা হয়েই আবু বকর রাঃ এর অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করলেন। প্রথমেই অভিযান প্রেরণ করলেন, পারস্যে সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে।
তৎকালীন পারস্যের বিখ্যাত সেনাপতি রুস্তমকে পরাজিত করার পর পারস্য তথা বর্তমান ইরান ইসলামি সাম্রাজ্য ভুক্ত হলো। এর পর পর‌্যায়ক্রমে কুফা,বসরা,সিরিয়া,দামেস্ক,মিসর ইত্যাদি জয় করলেন। উমর রাঃ এর শাসনামলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিজয় হলো- ৬৩৭ খ্রিঃ তৎকালীন রোমান শাসনকর্তাকে পরাজিত করে জেরুজালেম বিজয়। যেটি ইসলামের তৃতীয় পবিত্র ভূমি হিসেবে বিবেচিত।
ইসলামের শ্রেষ্ঠতম বিজেতা, ন্যায়বিচারক , পরাক্রমশালী এই মহান শাসক ৬৪৪ খ্রিঃ ইন্তেকাল করলে তার স্থালাবিশিষ্ট হন হযরত উসমান রাঃ। তিনি ৬৫৬ খ্রিঃ পর‌্যন্ত রাজত্ব করার পর ইন্তেকাল করলে, আলী রাঃ খুলাফায়ে রাশেদুনের চতুর্থ ও সর্বশেষ খলিফা হিসেবে খিলাফতে অধিষ্ঠিত হন। এবং ৬৬১ খ্রিঃ পর‌্যন্ত খিলাফতে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ইসলামের ইতিহাসে মহানবী সাঃ এবং খুলাফায়ে রাশেদুনের যুগে বর্তমান সৌদী আরবে অবস্থিত মদীনা ছিল সুবিশাল ইসলামী সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র তথা রাজধানী।
কিন্তু ৬৬১ ‍খ্রিঃ হযরত আলী রাঃ এর ইন্তেকালের মধ্যদিয়ে খুলাফায়ে রাশেদুনের যুগের অবসান হয়। এবং মুয়াবিয়া রাঃ বর্তমান সিরিয়ায় দামেস্ক কেন্দ্রীক উমাইয়া রাজবংশ প্রতিষ্টা করলে, মদীনা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক গুরুত্ব হ্রাস পাই। উমাইয়া আমলে মক্কা-মদীনা তথা হেজাজ উমাইয়া সাম্রাজ্যের প্রদেশ হিসেবে স্বীকৃতি ছিল। এবং উমাইয়া শাসকদের নির্বাচিত গভর্নররা মক্কা-মদীনা শাসন করতো।

মোঃ এমরান হোছাইন।
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, চ.বি।