Page 1 of 1

বাংলাদেশকে নিয়ে চীন-ভারত দ্বন্ধের নেপথ্যের কাহিনী কী?

Posted: Wed Oct 09, 2019 6:04 pm
by rafique
চীন-ভারত দ্বন্দ্বের মূলে রয়েছে বঙ্গোপসাগরে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা। এশিয়ার সবচেয়ে বড় দুই শক্তি চীন এবং ভারত সাম্প্রতিক সময়ে যেভাবে বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে, বাংলাদেশের গত ৪৭ বছরের ইতিহাসে তার নজির সম্ভবত নেই।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশকে নিয়ে চীন-ভারতের উত্তেজনার নমুনাঃ
- অস্ট্রেলিয়ান গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'ইস্ট এশিয়া ফোরামে'র প্রকাশিত নিবন্ধটির শিরোণাম, "চায়না এন্ড ইন্ডিয়া'স জিওপলিটিক্যাল টাগ অব ওয়ার ফর বাংলাদেশ"। অর্থাৎ বাংলাদেশ নিয়ে চীন এবং ভারতের ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব যুদ্ধ।"

নিউইয়র্ক ভিত্তিক 'ওয়ার্ল্ড পলিসি রিভিউ' এর শিরোনাম, "হোয়াই ইন্ডিয়া এন্ড চায়না আর কম্পিটিং ফর বেটার টাইস উইথ বাংলাদেশ।" অর্থাৎ বাংলাদেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়তে কেন ভারত আর চীনের মধ্যে এত প্রতিদ্বন্দ্বিতা?

দুটি লেখাতে বাংলাদেশের যেসকল বিষয়ে গুরুত্ব পেয়েছে তা হচ্ছেঃ-
১) বাংলাদেশের সঙ্গে চীন এবং ভারতের সম্পর্ক;
২) ব্যবসা-বাণিজ্য;
৩) নিরাপত্তা সহযোগিতা;
৪) বাংলাদেশর রাজনীতি ও নির্বাচন এবং
৫) দেশটির ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্য এই দুই বৃহৎ শক্তির দ্বন্দ্বের বিষয়ে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ রয়েছে।

কার অবস্থান কোথায়?
বাংলাদেশে প্রভাব বাড়াতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে
ভারত এবং চীন। দুটি দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের রয়েছে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক এবং সামরিক সহযোগিতার সম্পর্ক।

তবে এর মধ্যে ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কারণে ভারতের সঙ্গেই বাংলাদেশের সম্পর্কটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়।

চীন-ভারত বাংলাদেশে কি বানিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছে?
ইস্ট এশিয়া ফোরামের ফরেস্ট কুকসন এবং টম ফেলিক্স জোয়েনক বলছেন, বাংলাদেশের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় দুটি দেশই মূলত বাণিজ্যকেই ব্যবহার করতে চাইছে। বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দুটি দেশই সুবিধেজনক অবস্থানে আছে। দুটি দেশেরই বিপুল বাণিজ্য উদ্বৃত্ত আছে বাংলাদেশের সঙ্গে। দুই দেশের বাণিজ্যের একটি তুলনামূলক চিত্র তারা তুলে ধরেছেন তাদের লেখায়।

বাংলাদেশে চীনের বানিজ্যিক চিত্রঃ
চীন বাংলাদেশে রফতানি করে প্রায় ১৬ হতে ১৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, অথচ বাংলাদেশে থেকে আমদানি করে মাত্র ৭৫ কোটি ডলারের পণ্য। বাংলাদেশকে তারা বছরে একশো কোটি ডলারের সাহায্য দেয়। তবে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সফরের সময় চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২৪ বিলিয়ন বা দুই হাজার চারশো কোটি ডলারের সাহায্য দেয়ার কথা ঘোষণা করেন।

বাংলাদেশে ভারতের বানিজ্যিক চিত্রঃ
ভারত বাংলাদেশে রফতানি করে বছরে প্রায় আট বিলিয়ন ডলারের পণ্য। কিন্তু আমদানি করে মাত্র ২৬ কোটি ডলারের। কিন্তু দুদেশের মধ্যে অনেক 'ইনফরমাল ট্রেড' বা অবৈধ বাণিজ্য হয়, যা মূলত ভারতের অনুকুলে। এর পরিমাণ কমপক্ষে দুই হতে তিন বিলিয়ন ডলারের সমান হবে বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশে যে ভারতীয়রা কাজ করেন তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণও হবে দুই হতে চার বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশকে ভারত যে বৈদেশিক সহায়তা দেয় বছরে তার পরিমাণ পনের কোটি ডলারের মতো।

অবকাঠামো খাতে প্রতিযোগিতাঃ
ভারত-চীন যেসকল খাতে বাংলাদেশকে সাহায্য দিচ্ছে এবং সহযোগিতা করতে চাচ্ছে তা হলোঃ
১) বাংলাদেশে বড় আকারে রেল প্রকল্পে আগ্রহী দুটি দেশই।
২) গভীর সমূদ্র বন্দর স্থাপনেও ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে উভয় দেশের। কিন্তু এসব প্রকল্প খুব বেশি আগাচ্ছে না। ৩) ভারত বাংলাদেশের সুন্দরবনের কাছে যে কয়লা চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কাজ পেয়েছে সেটি বেশ কিছু বাস্তব এবং পরিবেশগত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

বাংলাদেশ কি ভারত-চীন প্রতিযোগিতার সুযোগ নিতে চাইছে?
ফরেস্ট কুকসন এবং টম ফেলিক্স জোয়েনক বলছেন, অবকাঠামো খাতে চীন-ভারতের এই প্রতিযোগিতা থেকে বাংলাদেশ খুব একটা লাভবান হয়নি। অন্যদিকে বাংলাদেশের ম্যানুফাকচারিং এবং জ্বালানি খাতে চীন বা ভারত, কেউই বড় কোন বিনিয়োগে যায়নি। যদিও তারা এধরণের বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে।

চীন বহু বছর ধরেই বাংলাদেশের সামরিক খাতে বড় সরবরাহকারী। ভারত এক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল, এখন তারা দ্রুত চীনকে ধরতে চাইছে। কিন্তু ভারতের সামরিক সরঞ্জামের মান নিয়ে প্রশ্ন আছে বাংলাদেশের।

বাংলাদেশে ভারত চীন থেকে কোন দিকে এগিয়ে?
চীনের তুলনায় ভারত যেদিকে এগিয়ে আছে, তা হলো বাংলাদেশের ওপর তাদের সাংস্কৃতিক প্রভাব। ফরেস্ট কুকসন এবং টম ফেলিক্স জোয়েনক বলছেন, এই প্রভাব খুবই ব্যাপক। দু্‌ই দেশের রয়েছে অভিন্ন ভাষা (বাংলা) এবং সংস্কৃতি, এবং এর একটি বড় কেন্দ্র এখনো কলকাতা। বাংলাদেশের অন্তত এক লাখ ছাত্র-ছাত্রী ভারতের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে।

এর বিপরীতে চীনের সাংস্কৃতিক প্রভাব নগণ্য। ঢাকায় চীন একটি কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছে। সেখানে চীনা ভাষা শেখানো হয়।

বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রশ্নে ভারতের অবস্থান কী?
ফরেস্ট কুকসন এবং টম ফেলিক্স জোয়েনক বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপিকে বর্ণনা করছেন একটি 'ইসলামপন্থী এবং পাকিস্তানপন্থী' দল হিসেবে। তাদের মতে, ২০০১ সাল হতে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দলটি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন যা ঘটেছিল, সেটা ভারতের মনে আছে এবং তাদের বাংলাদেশ বিষয়ক নীতি এবং ভাবনার গঠন সেটার ভিত্তিতেই। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কেউ বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসলে সেটা ভারতকে বিচলিত করবে।

তাঁরা আরও বলছেন, এ বিষয়ে দিল্লির কৌশল একেবারেই স্বলমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গী দ্বারা তাড়িত। তাদের কৌশলটা হচ্ছে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখা, সেই সঙ্গে ক্রমবর্ধমান চীনা প্রভাব ঠেকিয়ে দেয়া।

বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রশ্নে চীনের অবস্থান কী?
অন্যদিকে বাংলাদেশে চীন খেলছে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য সামনে রেখে। তারা এক দিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে। অন্যদিকে, এই দুজনের ভাষায়, 'ভারত বিরোধী এবং সেনাপন্থী' বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কের মাধ্যমে তারা একটা ভারসাম্য রাখছে।

চীন দীর্ঘমেয়াদী কৌশল মাথায় রেখে কাজ করছে, বিএনপির সঙ্গেও সম্পর্ক রাখছে তারা।

দুই বৃহৎ শক্তির দ্বন্দ্বের মাঝখানে পড়ে বাংলাদেশ কিভাবে তার সুবিধা নিচ্ছে?
ফরেস্ট কুকসন এবং টম ফেলিক্স জোয়েনক বলছেন, বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে এই ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাংলাদেশ কোন নিস্ক্রিয় 'ভিক্টিম' নয়, বরং নিজের কৌশলগত অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ এটি আরও উস্কে দিচ্ছে। তারা বলছেন, বাংলাদেশে এ নিয়ে সচেতনতা বাড়ছে যে দুটি দেশই আসলে বাংলাদেশকে যা দেয়, তার উল্টো অনেক বেশি নিয়ে যাচ্ছে। আর তাদের অবকাঠামো এবং ম্যানুফ্যাকচারিং প্রকল্পগুলি খুব নিম্নমানের (জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার তুলনায়)।

রোহিঙ্গা সংকট কি বাংলাদেশের প্রতি চীন-ভারতের চরিত্র উন্মোচন করেছে?
রোহিঙ্গা সংকটও বাংলাদেশকে বুঝিয়ে দিয়েছে চীন এবং ভারত আসলে কেবল 'সুদিনের বন্ধু। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদে যে কোন পদক্ষেপ চীন আটকে দিচ্ছে। এটাকে বাংলাদেশ বন্ধুত্বসুলভ কোন কাজ বলে মনে করে না। অন্যদিকে ভারতের অবস্থাও ভালো নয়। তারাও এই ইস্যুতে মিয়ানমারকে মদত দিয়ে যাচ্ছে।

তাহলে বাংলাদেশকে নিয়ে চীন-ভারত দ্বন্দ্বের ফল ভবিষ্যতে কী দাঁড়াবে?

তারা মনে করেন, শেষ পর্যন্ত এক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে দুই দেশের বাণিজ্য নীতি। দুটি দেশের কোনটিই বাংলাদেশকে রফতানির ক্ষেত্রে কোন ছাড় এখনো পর্যন্ত দিচ্ছে না। দুটি দেশই বাংলাদেশে রফতানির ক্ষেত্রে ব্যাপক 'আন্ডার ইনভয়েসিং' এর সুযোগ দিচ্ছে, যেটি কীনা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম-নীতির লঙ্ঘন। যত অর্থ তারা বাংলাদেশকে ঋণ দেয়, তার চেয়ে আরও অনেক বেশি অর্থ তারা নিয়ে নেয় এভাবে।

কিন্তু এক্ষেত্রে চীন আছে সুবিধেজনক অবস্থানে। তাদের অর্থনীতি ভারতের তুলনায় অনেক বড়। বাণিজ্যেও তারা এগিয়ে। কাজেই বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের জন্য চীন যদি কোনদিন তাদের বাজার খুলে দেয়, এই চীন-ভারত দ্বন্দ্বে সুস্পষ্টভাবেই চীন জয়ী হবে, বাংলাদেশ ঝুঁকে পড়বে তাদের দিকেই।

পরিশেষঃ
ফরেস্ট কুকসন এবং টম ফেলিক্স জোয়েনক তাদের উপসংহারে বলছেন, চীন আর ভারত সর্বোতভাবে চেষ্টা করবে বাংলাদেশের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বঙ্গোপসাগরে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় কে কার আগে থাকতে পারে। কিন্তু তাদের উভয়েই ব্যর্থ হবে, কারণ বাংলাদেশও এখন এ নিয়ে এক দেশকে অন্য দেশের বিরুদ্ধে খেলানোর মাধ্যমে এখান থেকে তাদের প্রাপ্য আদায়ের চেষ্টা করবে।

Collected